Homeসাহিত্যহাসান হাফিজের কবিতাভবন

হাসান হাফিজের কবিতাভবন


হাসান হাফিজ সত্তর দশকের কবি ও সাংবাদিক। দীর্ঘ ৪৯ বছর ধরে সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত। জন্ম ১৯৫৫ সালের ১৫ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার এলাহি নগর গ্রামে। তিনি সাহিত্য ও সাংবাদিকতা বিষয়ে প্রায় দুই শত গ্রন্থ রচনা করেছেন। পেয়েছেন শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক, ডাকসু সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, কলকাতার সৌহার্দ্য কবিতা উৎসব সম্মাননা, জাতীয় প্রেস ক্লাব লেখক সম্মাননা, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি লেখক সম্মাননাসহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা। 

বিশ শতকের সত্তরের দশকে আবির্ভূত কবি হাসান হাফিজ (জন্ম : ১৫ অক্টোবর ১৯৫৫) বাংলাদেশের কবিতার ধারায় প্রাতিস্বিক এক নাম। অর্ধশতাব্দীরও অধিককাল কবিতা-কক্ষপথে হেঁটেছেন তিনি, এখনো চলছে তাঁর পথপরিক্রমা, এরই মধ্যে নির্মাণ করেছেন স্বকীয় এক কবিতাভবন। হাসান হাফিজের এই কবিতাভবনের স্বাতন্ত্র্য কোথায়, কী আছে তাঁর কবিতার পঙক্তিমালায়। সে কথা পরোক্ষে কবি যেন নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন ‘কী কী থাকে কবিতায়’ শীর্ষক অসামান্য এক কবিতায়। ওই কবিতার পঙক্তিমালায় যে কথা উচ্চারিত, বস্তুত তা-ই যেন কবি হাসান হাফিজের কবিতাকথার অণুবিশ্ব। একবার নজর দেওয়া যাক হাসান হাফিজের শব্দমালায় : ‘ব্যর্থতার বিচিত্র ও বহুমুখী বিষ/বেদনাবধির অন্ধ অবসাদ/মরচে-পড়া স্বপ্নের পেরেক/হৃৎপিণ্ডের কোষে লাল ঝড়/ক্ষুধিত হা-য়ের প্রবলতা/হাতে-পায়ে শৃঙ্খলের বেড়ি/ফুলের পরাগে ঝোড়ো মেঘ/কখনো ঝিলিক দেয়া দ্যুতি/তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ/স্বাস্থ্যকর ভোরের বাতাস/দুটি দগ্ধ হাতের মমতা/চিরায়ত উদ্ধত মিছিল/ছলোছলো নদী নিরবধি/শাশ্বত ও সম্ভাবনাময়’। হাসান হাফিজের কবিতা গ্রাস করেছে উপর্যুক্ত যাবতীয় ভাব এবং অন্তিম বিচারে সেখানে শিল্পিতা পেয়েছে ঝিলিক দেওয়া মানবিক সম্ভাবনার দ্যুতি।

হাসান হাফিজ প্রেমের কবিーঅধরামাধুরী প্রেম তাঁর কবিতার কেন্দ্রীয় ভাব। এই প্রেম শুধু নারী-পুরুষের প্রেম নয়ーআরো অনেক বড় প্রেমーসে-প্রেম মানবিক প্রেম, স্বদেশ প্রেমーবিশ্বমানব চেতনাই যার কেন্দ্রীয় লক্ষণ। প্রসঙ্গত, মনে পড়ে তাঁর কবিতা সম্পর্কে আবদুল মান্নান সৈয়দের এই বিবেচনা : ‘হাসান হাফিজ মূলত প্রেমের কবিই। এই প্রেম নারী-পুরুষের প্রেমের অর্থে তো বটেই, বড় অর্থেও। হাসান হাফিজের কবিতা তাই নারীপ্রেম-পুরুষপ্রেমের বেদনা ও আনন্দ এবং বেদনানন্দ যেমন তুলে এনেছে, তেমনি জীবনের-পৃথিবীর-স্বদেশের-সমাজের-রাজনীতির ছায়াছবি তাঁর কবিতার চতুর্দিকে ঘূর্ণমান।’ প্রেমের ক্ষেত্রে দয়িতার কাছে সমর্পণই হয়ে ওঠে হাসান হাফিজের কবিতার কেন্দ্রীয় সুরーসমর্পণেই তিনি খুঁজে পান প্রাপ্তির পরম আনন্দ। ‘অনির্ণেয় অন্য কোনো মানে’ কবিতায় সে কথাই যেন উচ্চারিত : ‘এখানেই/আমার প্রকৃত হার।/আমি তার কাছে বারবার/পরাভূত হতে ভালোবাসি/ক্ষতস্থানে সবুজ মমতা/সঞ্জীবনী জল পেয়ে বড়ো হয়ে উঠি চারাগাছ’।

প্রেমের পাশাপাশি প্রকৃতিও হাসান হাফিজকে পৃথিবীর সব রোমান্টিক কবির মতোই কবিতা লিখতে প্রাণিত করে অবারিতভাবে। প্রকৃতি হাসান হাফিজের কাছে বেদনা-উপলব্ধির পরম উৎস, প্রকৃতি হাসান হাফিজের কাছে বেদনা থেকে মুক্তির অনাবিল বিশল্যকরণী, প্রকৃতি হাসান হাফিজের কাছে পরম কোনো দার্শনিক অভিজ্ঞানে উত্তরণের অব্যর্থ সঞ্জীবনী সুধা। প্রকৃতির সান্নিধ্যে এলে তাঁর কলমে অবলীলায় উদ্ভাসিত হয় এই সব পঙক্তিস্রোত : ‘শৈলমালা শিক্ষা দেয় প্রকৃতির অহিংস নির্বাণ’, কিংবা ‘সবুজ বৃক্ষের কাছে শিখতে হবে সহিষ্ণুতা’, কিংবা ‘সহনশীলতা শিখি, নিরন্তর পাঠ নিই/শ্যামলিমা বৃক্ষরাজি তোমাদের কাছে’, অথবা ‘নির্লোভ, উদার/পর্বতের শৃঙ্গে এলে নিজেকে সন্তের মতো মনে হয়।’ অসামান্য এসব উচ্চারণ থেকে বোঝা যায়, প্রকৃতি হাসান হাফিজের কাছে উপস্থিত হয়েছে পরম কোনো মানবিক-দার্শনিক চেতনায় উত্তরণের সোপান হিসেবে। প্রকৃতিচেতনায় হাসান হাফিজ আরোহী পদ্ধতির শিল্পীーবেদনার সহস্র রক্তস্রোত পাড়ি দিয়ে অবশেষে প্রকৃতির কাছে গিয়ে তিনি উপনীত হন গভীরতর কোনো সত্য-উপলব্ধিতে।

হাসান হাফিজ রোমান্টিক কবি, তবে তিনি অনায়াসেই তাঁর রোমান্টিক চেতনাকে বিমণ্ডিত করে দিতে পারঙ্গম বিশেষ কোনো মানবিক দর্শনে, গভীরতর কোনো জীবনার্থে। এই প্রবণতা হাসান হাফিজের কবিতার একটা বিশিষ্ট লক্ষণ। এভাবেই ‘উজ্জ্বল নতুন মাত্রা’ কবিতায় শিল্পিতা পায় ভালোবাসার অন্তর্দর্শন, ‘আমার শিশুপুত্র ও বাংলাদেশ’ কবিতায় ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা অসামান্য দার্শনিকতায় ঋদ্ধ হয়ে লাভ করে আন্তর্জাতিক সামষ্টিকতা। বাউল-দর্শনও কবি হাসান হাফিজকে নিজস্ব দার্শনিক চেতনায় উত্তরণে সঞ্চার করে অনেকান্ত অনুপ্রেরণা। তাঁর একাধিক কবিতায় বাউল-দর্শনের নবীন ভাষ্য শিল্পিতা পেয়েছে। প্রসঙ্গত মনে আসে ‘প্রেমের মড়া’, ‘কান্দি কষ্টে বিরানায়’, ‘বল ভরসা দাও রে দয়ায়’ ইত্যাদি কবিতার কথা। আন্তর্জাতিক চেতনাও হাসান হাফিজের কবিতায় শিল্পরূপ লাভ করেছে, যা মানবিক ভাবনায় ঋদ্ধ। এ প্রসঙ্গে ‘দুরন্ত কাশ্মীর’, ‘ফিলিস্তিন : যুদ্ধের অহংকার’ ইত্যাদি কবিতার কথা স্মরণে আসে।

স্বদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনীতির নানা অনুষঙ্গ মুখর হয়ে আছে হাসান হাফিজের কবিতায়। লক্ষণীয়, স্বদেশের অনুষঙ্গের কথা যখনই উচ্চারিত হয় হাসান হাফিজের পঙক্তিমালায়, সর্বত্রই সেখানে অন্তিমে পাওয়া যায় ইতিবাচক জীবনার্থের ছোঁয়া। ফলকথা, হাসান হাফিজ ব্যক্তিজীবন ও দেশ-জীবনকে দেখেন সদর্থক চেতনায়। এ প্রসঙ্গে তাঁর ‘নষ্ট ভ্রষ্ট সময়ের উদ্যত ফণার নিচে’, ‘শহীদ নূর হোসেন’, ‘দাঙ্গা’, ‘জনতার জয়’, ‘রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে’, ‘এ্যাসিডবিরোধী পঙক্তিমালা’ ইত্যাদি কবিতার কথা উল্লেখ করা যায়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধও হাসান হাফিজের কবিতায় বহুবিধ ব্যঞ্জনায় শিল্পরূপ লাভ করেছে।

নিুবর্গের জীবন-যন্ত্রণার শিল্পভাষ্য নির্মাণ হাসান হাফিজের কবিতার একটা সহজাত লক্ষণ। তাঁর অনেক কবিতায় নিম্নবর্গের মানুষের প্রতি ভালোবাসার কথা উচ্চারিত হয়েছে। তিনি প্রত্যাশা করেছেন নিম্নবর্গের মানুষের সামূহিক মুক্তি। এই মুক্তি-আকাঙ্ক্ষাই তাঁকে নিয়ে যায় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকায়, তাঁকে নিয়ে যায় জনতার মিছিলে। মানুষের সামূহিক মুক্তিবাসনা হাসান হাফিজকে করে তোলে প্রতিশোধপ্রবণ, কবিতায় উচ্চারিত হয় তাঁর সেই প্রতিশোধ কিংবা প্রতিরোধ বাসনা : ‘জন্মের অর্ধেকটা কাল কেটে গেল ভিক্ষা প্রার্থনায়। আমি আর/ভিক্ষাবৃত্তি পছন্দ করি না। ক্রমশ বিশ্বাসী হচ্ছি লুটতরাজে,/হিংসা ক্ষোভে বারুদে বোমায় রূঢ় আগ্নেয়াস্ত্রে হয়তো সম্ভবপর/জয়ের উন্নত টুঁটি টিপে ধরা। বিস্তর খেয়েছি দাগাーবন্ধু আর নয়/এবার সহিংস পন্থা প্রতিশোধ গ্রহণের শুভারম্ভ, চেক, চেক, চেকー(‘চরিত্র বদন’)।

হাসান হাফিজের কবিতায় পাওয়া যায় ভ্রমণের স্বাদ। তাঁর অনেক কবিতা নির্মিত হয়েছে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে। কবি আর কবিতা-বিষয়ে কবিতা লেখাও হাসান হাফিজের একটি প্রিয় প্রবণতা। সামান্য বিষয় নিয়ে অসামান্য ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয় হাসান হাফিজের অনেক পঙক্তিস্রোতে, অনেক কবিতায়। গভীরতর দার্শনিক চেতনায় শিল্পবোধ জারিত না হলে এটা যে সম্ভব নয়, সচেতন পাঠক নিশ্চয়ই তা স্বীকার করবেন।

বিষয়ের পাশাপাশি প্রকরণ পরিচর্যায়ও হাসান হাফিজ কুশলী শিল্পী। তিনি আমাদের অন্যতম ছন্দ-সচেতন কবি। কবিতায় লোকভাষা ব্যবহার, নাট্যরীতি, প্রবাদপ্রতিম চরণ নির্মাণ কিংবা চিত্রকল্প-সমাসোক্তি-উপমা সৃষ্টিতে হাসান হাফিজের প্রাতিস্বিক শিল্পবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। হাসান হাফিজের কবিতা মানুষের সামূহিক অগ্রযাত্রাকে ধারণ করুক, তাঁর কবিতা পাঠককে নতুন জীবনবোধে সন্দীপিত করুকーএই-ই আমাদের আত্যন্তিক প্রত্যাশা। জন্মদিনে তাঁকে অভিবাদন।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত