[ad_1]
ইভান আলেক্সিভিচ বুনিন রাশিয়ান কবি ও ঔপন্যাসিক, যিনি রুশ সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার পান ১৯৩৩ সালে। ম্যাক্সিম গোর্কি বুনিনকে রাশিয়ার জীবিত লেখকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম বলে বিবেচনা করেছিলেন। রোমান্টিক গতিময়তায় লেখা তার ‘মিতিয়াস লাভ’ উপন্যাসটি যৌবনের প্রেমবোধ ও অনুভব নিয়ে সরল, নিরীহ ও বিয়োগান্ত এক মনোগ্রাহী লেখা। সাধারণকে অসাধারণে পরিণত করার গোপন রহস্য ও নিপুণ গদ্যময়তা ইভান বুনিনের লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ‘মিতিয়াস লাভ’ ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন, ম্যাডেলিন বয়েড এবং বইটির ভূমিকা লিখেছেন আর্নেস্ট বয়েড।
তারপর সবকিছু খুব স্বাভাবিকভাবেই চলছিল।
মিতিয়া কাতিয়াকে নিয়ে আর্ট থিয়েটার স্টুডিয়োতে, গানের আসরে, সাহিত্যের আড্ডায়, এমনকি কাতিয়ার বাসায়ও সময় কাটাতে লাগল। কখনও কখনও রাত দুইটা পর্যন্ত সে কাতিয়ার সঙ্গে সময় কাটাল, কারণ কাতিয়ার মা তাকে এই স্বাধীনতা দেওয়ায় সে কৃতজ্ঞ ছিল। কাতিয়ার মা অত্যন্ত সহজ ধরনের একজন মহিলা, যিনি সবসময় লাল চুলে সজ্জিত, সবসময় সিগারেট খেতে পছন্দ করেন। তিনি দীর্ঘদিন স্বামীর কাছ থেকে অনেক দূরে, আলাদাই থাকেন, আর তার স্বামী ইতোমধ্যেই আরেকটি পরিবারকে গ্রহণ করেছেন। কাতিয়া মাঝেমাঝে আসবাবপত্র দিয়ে গোছানো মিতিয়ার রুমে আসত, এবং তারা পরস্পরকে গভীরভাবে চুম্বন করত। কিন্তু মিতিয়ার মনে হত, ভয়ংকর একটা কিছু ঘটে গেছে কাতিয়ার মধ্যে, ও মিতিয়ার প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গিটাও যেন বদলে গেছে।
চমৎকার অবিস্মরণীয় সময়টা কীসের মধ্যে দিয়ে যেন পার হয়ে গেল, তখন তারা যে পরস্পরকে খুব ভালোভাবে চিনত তা নয়, কিন্তু তাদের মনে হত দুজন-দুজনকে পাওয়ার মধ্যেই পৃথিবীর যত সুখ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তারা কথা বলত, এবং সেই চমৎকার সময়ে মিতিয়ার মনে হত, সে যে শৈশব থেকে যে বিস্ময়কর ভালোবাসার সন্ধানে ছিল, তা যেন সে খুঁজে পেয়েছিল কাতিয়ার ভিতরে। তাদের দেখা হয়েছিল ডিসেম্বরের শুষ্ক ও ঠান্ডা বরফ দিনগুলিতে যখন মস্কো শহর প্রতিদিনই ঢেকে যেত সাদা তুষারে, সূর্যটাকে মনে হত পৃথিবীর খুব কাছের একটি অস্পষ্ট লাল গোলক যা কুয়াশায় ঢাকা, যার আভায় পৃথিবীটা আলোকিত হত। একটি যথার্থ প্রেমের ঘূর্ণিতে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই দুটি মাস মিতিয়ার মনে হয়েছিল সে অবিরাম সুখের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, জন্ম নেয়া সুন্দর ভালোবাসাটা মাত্র দুমাসের ভিতর তিক্ত হয়ে গেল। এরমধ্যেই তার মনে হতে থাকল, কাতিয়ার একটা দ্বৈতসত্তা আছে, প্রথম দেখার মুহূর্তে যাকে সে ভালোবেসেছিল, আকাঙ্ক্ষা করেছিল এবং যাকে সে নিজের ভেতর আপন করে নিয়েছিল সেই সত্তাটির পাশাপাশি আরেকটি সত্তা অতি সাধারণ যা প্রথমটির প্রেমময় সত্তাটির সঙ্গে কোনোভাবেই মেলে না। কিন্তু আজ ৯ মার্চ সে বিষয়টিকে যেভাবে অনুভব করছে এত তীব্রভাবে সে এর আগে অনুভব করেনি।
অবশ্য এটা খুব সহজইে ব্যাখ্যা করা যায়।
বসন্ত আসার সঙ্গে সঙ্গে কিছু রমণীয় কাজকর্ম দেখা দেয়। শীতের কাপড়গুলোর পরিবর্তে নতুন কাপড়ের প্রয়োজনীয়তা, নতুন ডিজাইনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কাতিয়ার স্বাভাবিকভাবেই মায়ের সঙ্গে যেতে হত কাপড় বানানোর জন্য দর্জির কাছে, ফ্যাশনের দোকানগুলোতে, আর থিয়েটার স্কুলে উপস্থিত থাকতে হত বলে কাপড়ও কিনতে হত। মিতিয়া নিজেকে শান্ত রাখার জন্য প্রতি মুহূর্তে তার মনকে বোঝাত, ঠিকতো! আসলে স্বাভাবিকভাবেইতো কাতিয়ার এই কাজগুলি করতে হয়! কিন্তু এই সান্ত্বনা শেষপর্যন্ত কার্যকর হত না, প্রতিদিনই তার সন্দেহবাতিক মন নানা কানাঘুষা করতে থাকতো উচ্চকিতভাবে ও জেদিভাবে। মনের এই অবস্থা তাকে তীব্রভাবে ঈর্ষান্বিত করে ফেলত। থিয়েটার স্কুলের ডিরেক্টর যে প্রশংসাসূচক কথাগুলো কাতিয়াকে বলত, সেসব কথা সে মিতিয়াকে সরল মনে বলে দিত। ডিরেক্টর তাকে বলেছিল, ‘তুমি হলে আমার স্কুলের তারকা ছাত্রী।’ এবং পাশাপাশি এও বলেছিল, ‘লম্বা ছুটির সময় সাধারণ কোর্সের পাশাপাশি সে তাকে আরও কিছু পাঠদান করবে, যাতে সে পরীক্ষায় ভালো করতে পারে।’ তবে সে লোকটির একটি দুর্নাম ছিল, অন্যকে প্রলুব্ধ করার, এবং প্রতি বছর সে তার ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ককেসাস, ফিনল্যান্ড ও অন্য দেশে যেত। মিতিয়া নিজেকেই বিশ্বাস করালো, নিশ্চয়ই ডিরেক্টরের কাতিয়ার উপর চোখ পড়েছে, যদিও মিতিয়া খুব ভালো করেই জানে কাতিয়ার এতে কোনো আগ্রহ নেই, তবু তার মনে হলো ডিরেক্টরের সাথে তার সম্পর্কটি একটি লজ্জাজনক সম্পর্ক। এই চিন্তাটা তাকে বড় বেশি পীড়িত করেছিল, পাশাপাশি কাতিয়ার উদাসীনতাও অনেক বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছিল।
মনে হচ্ছিল কাতিয়া তার কাছ থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। সে ডিরেক্টরের বিষয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারছিল না। এবং এটাই যদি শেষ হতো, তবুও কথা ছিল। বরং মিতিয়ার মনে হতে লাগল কাতিয়ার তার প্রতি ভালোবাসার চেয়েও অন্য অনেক বিষয়ে আগ্রহ আছে। কার প্রতি তার এত আগ্রহ! কীসের প্রতি! মিতিয়া জানে না। মিতিয়া সবার প্রতি ঈর্ষান্বিত, সবকিছুর প্রতি ঈর্ষান্বিত এবং কাতিয়া যে যে কারণে তাকে ছাড়া বাঁচতে পারে তার সবকিছুকে সে কল্পনা করে ঈর্ষা করে। সে ভাবছিল, আর ভীত হয়ে পড়ছিল এটা ভেবে যে কিছু একটা কাতিয়াকে অবশ্যম্ভাবিভাবেই তার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। একদিন কাতিয়ার মায়ের উপস্থিতিতেই কাতিয়া হালকা তামাশা করে বলছিল, ‘মিতিয়া, সব কিছু বিবেচনা করে দেখলাম, নারীদের সম্পর্কে তোমার চিন্তাধারা একেবারেই প্রাচীনপন্থি ও গার্হস্থ্যমুখী। তুমি একজন সত্যিকারের ওথেলো। এমন একজন ওথেলোর সঙ্গে আমার প্রেম ও বিয়ে হতে পারে না।’
তার মা বলে উঠল— ‘প্রেম আছে, কিন্তু ঈর্ষা নেই এটা আমি ভাবতেও পারি না। আমার মতে যাদের ঈর্ষা নেই তাদের প্রেমও নেই।’
‘না মা, ভালোবাসায় হিংসা থাকা মানে ভালোবাসায় ঘাটতি আছে। যদি আমাকে বিশ্বাস না করা যায়, তার মানে আমাকে ভালোবাসাও যায় না।’ মিতিয়ার দিকে না তাকিয়েই সে কথাগুলো বলছিল।
তার মা বলতে লাগল, ‘ঈর্ষা ও প্রেম সমার্থক। আমি এটা কয়েক জায়গায় পড়েছি। বাইবেল থেকে উদাহরণ নিয়ে বলতে পারব, ঈশ্বর নিজেই হচ্ছেন ঈর্ষান্বিত ও প্রতিশোধপরায়ণ এক সত্তা।’
এরপর থেকে লক্ষ্য করা গেল, মিতিয়ার প্রেম ঈর্ষার সঙ্গে একেবারে জড়িয়ে আছে। তার কাছে মনে হলো এটা কোনো সাধারণ ঈর্ষা নয়, এটা এক বিশেষ রকমের ঈর্ষা। কাতিয়া ও তার মধ্যে এখনও কোনো গভীর অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়নি, তারপরেও তারা যখন একা থাকে তাদের ভাবনাগুলো তাদেরকে শারীরিকভাবে অনেক গভীরে নিয়ে যায়। এবং এখন এই সময়গুলোতে কাতিয়া আগের তুলনায় আরও অনেক বেশি কামার্ত। কিন্তু কাতিয়া যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিতিয়াকে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসছে, এসবও মিতিয়া ভয়ংকর সব ভাবনা মিলিয়ে সন্দেহের চোখে দেখছে। তার ঈর্ষান্বিত চিন্তাগুলোর মধ্যে সবকয়টিই ছিল ভয়ংকর, কিন্তু তার মধ্যে একটি বিশেষ ভাবনা ছিল ভয়াবহ, যেটি মিতিয়া নিজেও বুঝতে পারত না। যখন ওরা অন্তরঙ্গভাবে পরস্পরকে কাছে পাচ্ছে তখন তার মনে হত তা হচ্ছে পৃথিবীর অপরিমেয় সৌন্দর্য, আনন্দ ও সুখের প্রকাশ কিন্তু পরক্ষণেই যখন সে ভাবতো কাতিয়া অন্য কারো সঙ্গে আছে, তখন তা অসম্ভব বীভৎস আর বিকৃতরূপে তার কাছে অবতীর্ণ হত। কাতিয়ার প্রতি তখন প্রচণ্ড ঘৃণা ও উগ্র শরীরী বিতৃষ্ণা কাজ করতে থাকত। যা কিছু পবিত্র, সুন্দর আর চিত্তাকর্ষক তা শুধুমাত্র তাদের দুজনের মিলনের মধ্যেই আছে। কিন্তু যখনই সে তার জায়গায় অন্য পুরুষকে ভাবছে, তখনই বিষয়টি একেবারে ভিন্নরকম হয়ে যাচ্ছে। সৌন্দর্যের সবটুকুই রূপান্তরিত হয়ে যেত প্রচণ্ড নীচুতায় আর বর্বরতায়, যা তার মধ্যে কাতিয়াকে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলবার ভয়ংকর ইচ্ছে জাগাত—শুধু কাতিয়াকেই, পুরুষটিকে নয়।চলবে
[ad_2]
Source link