Homeসাহিত্যমানবসত্তার স্বরূপই সুলতানের মূলমন্ত্র

মানবসত্তার স্বরূপই সুলতানের মূলমন্ত্র

[ad_1]

বাংলা চিত্রকলার ইতিহাসে এক অম্লান উজ্জ্বলতম শিল্পীর জীবন নদীর মতো বাঁক নিয়েছিল অসংখ্যবার। কখনো এ বাংলায় তো কখনো ওপার বাংলায়, কখনো কাশ্মীর হয়ে লাহোর করাচি কিংবা পশ্চিমা দেশের সীমানায়। এই নদীর নাম এস এম সুলতান। পুরো নাম শেখ মোহাম্মদ সুলতান। ডাক নাম লাল মিয়া। বাংলা ও বৈশ্বিক শিল্পাঙ্গনে তিনি উজ্জ্বল নক্ষত্র। অসংখ্য বার বাঁক নিয়ে এই নদী ফিরে এসেছিল তার আদিম পরিচয়ে—তার নিজ প্রাঙ্গণে মাটি ভিজিয়ে উর্বর করতে। সেদিন আপন মাটির কাছে তুচ্ছ হয়েছিল আন্তর্জাতিক শিল্পাঙ্গন কিংবা বিলাসবহুল জীবন। তার শিল্পকর্ম মেঘমুক্ত আকাশের মতো প্রশান্ত হলেও, তাতে নিহিত রয়েছে গভীর অনুভূতির রেশ। সহজ ভাষায় বারবার বলে গিয়েছেন দুঃখী গরিব মানুষের কষ্ট, কথা, সুখ এবং তাদের গৌরবময় জীবন। সুলতান তার শিল্পে প্রাত্যহিক জীবনের সাধারণ বিষয়বস্তু চিত্রিত করেছেন, কিন্তু তাদের সৌন্দর্য ও অর্থময়তা কেবল তার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই সম্ভব।

শিল্প জীবনের শুরুর দিকে তার কাজে বিভিন্ন সমসাময়িক শিল্প ধারার বৈশিষ্ট্যের প্রভাব থাকলেও পরবর্তীতে তিনি বহির্বিশ্বে প্রচলিত নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যদিয়ে উজ্জীবিত হওয়া কোনো এভানগার্ড শিল্পের পরিচর্যায় বিশ্বাসী ছিলেন না। বরং সেই সময়ও তিনি সহজ সরল মানুষগুলোর কথা ভেবেছেন, গ্রামীণ জনজীবনের চিত্র এঁকেছেন। যারা হয়ত সেই এভানগার্ড আর্টের সারকথা বুঝবেন না, কিন্তু সেই গ্রামীণ মানুষগুলোর মধ্যেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন অফুরন্ত প্রাণ শক্তির ভাণ্ডার। যার উপর ভর করে তিনি রচনা করেছেন সময়ের সবচেয়ে বড় শিল্প রসদ ভাণ্ডার। যার বিশেষত্ব ফুটে উঠেছে গভীর মানবিক অনুভূতি এবং প্রকৃতি প্রেমের মধ্য দিয়ে। তিনি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে একটি গভীর সৌন্দর্যের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন এবং তার চিত্রকর্মে ফুটে উঠেছে প্রকৃতির প্রতি এক অদ্ভুত আন্তরিকতা। নদী, চর, নৌকা, মানুষ এসবের মধ্যে এক অনন্য সংযোগ স্থাপন করেছেন।

তার চিত্রকর্মের মূল চরিত্র হয়ে ওঠে গ্রাম বাংলার চিরচেনা কৃষক, নারী, জেলে, শিশু, পশুপাখি অর্থাৎ সাধারণ মানুষ। তারা যেন সৃষ্টির অংশ হতে চায়, নিজেদের অতীতের সাথে একাত্ম হতে চায়। সুলতান তার শিল্পের মাধ্যমে এদের অনুভূতি, আশা এবং স্বপ্নগুলোকে প্রতিফলিত করেছেন। কৃষকদের রুগ্ণ শরীর, ক্ষুধার যন্ত্রণা নিয়েই চলে প্রকৃতি এবং কৃত্রিম সংকটের সঙ্গে প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব যুদ্ধ। তবুও যেন তারা থেমে নেই, তারা যেন কোনো এক ব্রতে ব্রতী রয়েছেন শুধু সৃষ্টি করে যেতে। তিনি তাদের সম্বল করে এঁকে গেছেন তাদের জীবন গাঁথা। পুঁজিবাদী সমাজে খুব সহজেই ভোগ্যপণ্য হয় এই কৃষকরা। সুলতানের কথায়, “দিন যায় দিন আসে, এদের ভাগ্য বদলায় না। রুগ্ণ শরীর ক্রমশ রুগ্ণ হয়, যেন একটা প্রহসন চলছে এদের নিয়ে”। তবুও তিনি লক্ষ্য করেছিলেন তাদের উজ্জীবিত প্রাণশক্তি, সমস্ত প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে তাদের ফসল ফলানোর একাগ্রতা। কৃষক-কেন্দ্রিক চিত্রকর্মগুলো তারই বহিঃপ্রকাশ। সংগ্রামী মনোভাব ফুটিয়ে তোলার জন্য তিনি তার ছবিতে আনলেন এক ধরনের ‘অ্যানাটমি ডিসটরশন’। তিনি কৃষকদের দেখিয়েছেন পেশীবহুল শক্তপোক্ত সুষম দেহের অধিকারী যা মূলত বাস্তবতার একদম বিপরীত চিত্র— এখানে তিনি রূপক অর্থে তাদের অপরিসীম জীবনশক্তির প্রকাশ দেখিয়েছেন। সুলতানের ছবিতে শুধু কৃষক নয়, সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষের এনাটমিও ছিল সুগঠিত। এমনকি তার ছবির গোরুও ছিল পেশিবহুল। পরবর্তীকালে তিনি নারীদেরও উপস্থাপন করেছিলেন খেটে খাওয়া সংগ্রামী সেই জীবনযাত্রার সহযোদ্ধা হিসেবে। তিনি তাদের আশ্বাস দিয়ে বলেন “তোমরা মোটেও ভয় পাবে না, তোমরা টিকে থাকবে। তোমরাই জমির প্রকৃত অধিকারী। মাটির সাথে সম্পর্ক তোমাদের ওদের নয় যারা তোমাদের উপহাস করে।” তার কৃষক যেমন ছিলেন ব্রতী ফসল ফলাতে, একজন শিল্পী সুলতানও ছিলেন তেমনি ব্রতী তার সৃষ্টিতে।

একজন শিল্পী সুলতান ম্যাটারিয়ালাস্টিক অর্থে হারিয়েছে অনেক কিছুই কিন্তু সুলতান নিজের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন প্রকৃত মানবসত্তার স্বরূপ। নাম, জশ, খ্যাতি, নারী, বিষয়-সম্পত্তি কোনো কিছুকেই তিনি জীবনের প্রকৃত গন্তব্য হিসাবে চিন্তা করেননি। যদিও তার স্নেহ ছিল, আনন্দ-বেদনা, ভালোবাসা-অভিমানও ছিল। কিন্তু এই অঙ্গগুলোকে তিনি তার জীবনে কখনো চিরস্থায়ী করেননি। নদীর মতো বয়ে চলা মানুষটি এভাবেই জীবন তরী বেয়ে গেছেন। মানবসত্তার স্বরূপই ছিল তার শিল্প রচনার মূলমন্ত্র। যেখানে সুলতান একা একক যাত্রী এবং জীবনমুখী। এই কারণে তিনি কোথাও একটা নির্দিষ্ট ধারার উত্তরাধিকারী নয়। আধুনিক শিল্প তার কাছে অনেকটাই ভাববিলাস স্বরূপ তাই তার ছবির গ্রাম পরিচিত, সরল এবং প্রকৃতির সাথে সংযুক্ত। তার কাজের মধ্যে রঙের ব্যবহার অত্যন্ত উজ্জ্বল এবং প্রাণবন্ত। তার চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে রেখার সংজ্ঞা সহজ এবং স্পষ্ট যা একটি বিশেষ ধরনের সৃজনশীলতা প্রকাশ করে।

এসএম সুলতান শিল্পের ক্ষেত্রে মৌলিকতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি কখনোই চলতি ধারার সাথে আপস করেননি বরং নিজের শৈল্পিক দৃঢ়তা এবং সৃজনশীলতার মাধ্যমে নিজস্ব একটি পথ তৈরি করেছেন। তার কাজগুলো চিত্রকলার প্রথাগত ধারণা থেকে দূরে সরে গিয়ে নতুন এক ভাষার জন্ম দিয়েছে, যেটা তার একান্তই নিজের। শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সুলতান সম্পর্কে এক লেখায় বলেছিলেন— “তিনি ফর্মের নিরীক্ষাকে গুরুত্ব দেননি, দিয়েছেন মানুষের ভেতরের শক্তির উত্থানকে, ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এবং ঔপনিবেশিক সংগ্রামের নানা প্রকাশকে তিনি সময়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপন করেছেন। এটাই তাঁর কাছে ছিল ‘আধুনিকতা’, অর্থাৎ তিনি ইউরো-কেন্দ্রিক, নগর নির্ভর, যান্ত্রিকতা-আবদ্ধ আধুনিকতার পরিবর্তে অন্বেষণ করেছেন অনেকটা ইউরোপের রেনেসাঁর শিল্পীদের মতো মানবের কর্মবিশ্বকে।”
সুলতান পূর্বপুরুষদের প্রকৃতি এবং ইতিহাসের কাছে ঋণী। একই সাথে তিনি ঋণমুক্ত হয়েছেন বাংলার শিল্পের নতুন সূর্যোদয় করে। একজন শিল্পীর ঋণ মুক্ত হওয়ার উপায় তো এটাই— একটা নতুন সূর্যের উদয় করা।

শিল্পী অনেক আগে থেকেই চেয়েছিলেন শিশুদের সুকুমারবৃত্তিতে গড়ে তুলতে। নিজ গ্রাম নড়াইলে শিশুসর্গ নামে ছোট পরিসরে শিক্ষাঙ্গণ শুরু করেছিলেন জীবদ্দশায়। এছাড়াও বাংলার সহায় সম্বলহীন শিশুদের ছবি আঁকার চর্চার সুবিধার্থে চটের ক্যানভাস প্রস্তুতিকরণ, কম খরচে তেল রং তৈরির অভিনব পদ্ধতি দেখিয়েছিলেন এবং তিনি নিজেও একইভাবে ছবি এঁকে গেছেন। একসময় তিনি শিশুদের জন্য একটি বড় কাঠের নৌকাও তৈরি করেছিলেন যেন শিশুরা সেই নৌকায় চড়ে শিল্পচর্চা করতে পারে। তিনি বলতেন, “যে শিশু সুন্দর ছবি আঁকে, তার গ্রামের ছবি আঁকে, সে সুন্দর ফুলের ছবি আঁকে, তার জীবজন্তুর ছবি আঁকে, গাছপালার ছবি আঁকে, সে কোনোদিন অপরাধ করতে পারে না, সে কোনোদিন কাউকে ব্যথা দিতে পারে না।” বোহেমিয়ান এবং খেয়ালি বৈরাগী বাউল সুলতান কারো কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন না। তার দায়বদ্ধতা ছিল নিজের কাছে, বাংলার মানুষের কাছে। তিনি চেয়েছিলেন একটি মঙ্গলালোক, আনন্দলোক সমাজ। তিনি চেয়েছিলেন অভয়রাণ্য। ছবিতে বলেছেন বারবার ঘুরে দাঁড়ানোর কথা, অধিকার আদায়ে আদিম হয়ে ওঠার কথা, বলেছেন মাটির কথা।

জীবন কথা : ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট নড়াইলে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তার ছবি আঁকতে ভালো লাগত—সেখান থেকেই শুরু। কলকাতা আর্ট কলেজে ছবি আঁকার উচ্চতর শিক্ষা পেতে শিল্প সমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দী তাকে বিশেষ সহযোগিতা করেছিলেন। কিন্তু তার স্বভাবজাত বোহেমিয়ান জীবন বৈশিষ্ট্যের কারণে মাত্র ৩ বছর সেখানে শিল্প শিক্ষা গ্রহণ করতে সক্ষম হন। পরবর্তীকালে তিনি ভারত ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন, এরপর একসময় যাযাবর গোষ্ঠীগুলোর সাথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয় এবং তাদের সাথে তিনি তিন বছর কাশ্মীরে অবস্থান করেন। সে সময় তিনি সেখানকার নিসর্গ চিত্রগুলো তৈরি করেন। এরপর তিনি চলে আসেন শিমলাতে—সেখানে ১৯৪৬ সালে তার প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের লাহোরে চলে আসেন এবং পরবর্তীতে করাচীতে তিনি স্থায়ী হন। পাকিস্তানের তত্ত্বাবধানে তিনি প্রথম এশিয়ার বাইরে পা রাখেন। সেই সূত্রে অগ্রসর হয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের সেরা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে পিকাসো, সালভাদোর ডালি, মাতিস এবং ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের মতো বিশ্বখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে গ্রুপ এক্সিবিশনে অংশগ্রহণ করেন। এরপর পাকিস্তানেও বেশিদিন তার মন টেকেনি, বোহেমিয়ান সুলতানের পরবর্তী যাত্রা হয় নিজ জন্মভূমি নড়াইলে। তখনই আমাদের উপহার দিতে থাকেন অসাধারণ সব শিল্পকর্ম: প্রথম বৃক্ষরোপণ, চর দখল, ক্ষেতদখল, যাত্রা, মাছধরা, শাপলা তোলা, ধানমাড়াই। একাত্তরের বিশাল গণজাগরণ তার ভেতর অভূতপূর্ব এক পরিবর্তন আনে যা তার শিল্পী সত্তায় বিশেষ প্রভাব ফেলে। ১৯৬৭ সালে দেশের মাটিতে তার প্রথম প্রদর্শনী হয়। ১৯৮২ সালে তিনি একুশে পদক গ্রহণ করেন। ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর দেশ বরেণ্য এই শিল্পীর জীবনযাত্রার সমাপ্তি ঘটে।



[ad_2]

Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত