Homeঅর্থনীতিবস্ত্রে কর দ্বিগুণ, ব্যক্তিও চাপে

বস্ত্রে কর দ্বিগুণ, ব্যক্তিও চাপে


চাপে থাকা ব্যবসার কাঁধে এবার আরও ভারী হচ্ছে করের বোঝা। একদিকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে হাঁসফাঁস করছে শিল্প, অন্যদিকে কম মুনাফায় টিকে থাকা প্রতিষ্ঠানের ওপরও বসছে অতিরিক্ত করের খড়্গ। আসছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে কর ছাড়ের পথ থেকে সরে এসে রাজস্ব সংগ্রহের কঠিন কৌশল নিচ্ছে সরকার; যার প্রথম আঘাত যাচ্ছে সরাসরি টেক্সটাইল ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ওপর।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চূড়ান্ত করতে চলেছে একগুচ্ছ প্রস্তাব; যার আওতায় টেক্সটাইল খাতের কর রেয়াত সুবিধা উঠে যাচ্ছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বাড়ছে ন্যূনতম টার্নওভার করের হার, আর ব্যক্তির ক্ষেত্রেও এই কর চার গুণ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাবও থাকছে। নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, রাজস্ব ঘাটতি পোষাতে এসব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হলেও শিল্পসংশ্লিষ্টদের মতে, এটি দেশের উৎপাদন ও রপ্তানিমুখী অর্থনীতির জন্য একধরনের বিপর্যয় ডেকে আনবে।

এনবিআরের তথ্য বলছে, টেক্সটাইল খাতের ১৫ শতাংশ কর রেয়াত তুলে দিলে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির জন্য করহার হবে ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ; যা প্রায় ৮৩ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটতে চলেছে। অথচ বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সদস্য ১ হাজার ৮৫৪টি কোম্পানির মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত শুধু ৫৮টি। ফলে সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানই বাড়তি করের সরাসরি শিকার হবে।

আরও বড় চাপ আসছে ন্যূনতম করের খাতে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর ০.৬ শতাংশ ন্যূনতম কর বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা হচ্ছে, যা ৬৭ শতাংশ বৃদ্ধি। ব্যক্তি পর্যায়ে বার্ষিক ৩ কোটি টাকার বেশি আয়ের ওপর ন্যূনতম কর ০.২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করার প্রস্তাব রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মুনাফা বিবেচনায় কর নির্ধারণের বদলে টার্নওভারের ওপর কর চাপানোয় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন মূলত সৎ করদাতারা।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সহসভাপতি সালেউদ্দিন জামান খান এ প্রসঙ্গে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের করহার ১৫ শতাংশ বলা হলেও কার্যকর হার অনেক বেশি। মুনাফা মাত্র ৩ শতাংশ হলেও ১ শতাংশ উৎসে কর দিতে হয়; মানে কার্যকর হার দাঁড়ায় ৩৩ শতাংশ। এখন ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর এলে এবং উৎসে কর সমন্বয় না থাকলে কার্যকর করহার গিয়ে দাঁড়াবে ৬৬ শতাংশ।’ তিনি দাবি করেন, ‘যদি সত্যি সত্যি প্রস্তাব কার্যকর হয়, তাহলে এই পরিস্থিতিতে টেক্সটাইল শিল্পের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে।’

রপ্তানির ক্ষেত্রে সুতা ও কাপড়ের ওপর ১ শতাংশ এবং স্থানীয় বাজারে বিক্রিতে ৪ শতাংশ উৎসে কর বসায় অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান লোকসানে চলছে বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্টরা। সেই সঙ্গে তুলা ও কৃত্রিম তন্তু আমদানিতে নতুন করে ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর আরোপের চিন্তাও করছে সরকার।

রেয়াত তুলে নেওয়া যেতে পারে, তবে কর নির্ধারণ হওয়া উচিত প্রকৃত মুনাফার ভিত্তিতে। মুনাফা বেশি হলে বেশি কর, না হলে কর নয়—এটাই ন্যায্য। ড. সৈয়দ মো. আমিনুল করিম, অর্থনীতিবিদ ও এনবিআরের সাবেক সদস্য

এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ বিষয়ে জানিয়েছেন, আগামী জুনে টেক্সটাইল খাতের কর রেয়াত মেয়াদ শেষ হলে তা আর নবায়ন করা হবে না। তিনি বলেন, ‘উন্নয়ন সহযোগীরা রেয়াত তুলে ধাপে ধাপে কর আদায় বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে। সেভাবেই পরিকল্পনা করা হয়েছে।’

অর্থনীতিবিদ ও এনবিআরের সাবেক সদস্য ড. সৈয়দ মো. আমিনুল করিম মনে করেন, রেয়াত তুলে নেওয়া যেতে পারে, তবে কর নির্ধারণ হওয়া উচিত প্রকৃত মুনাফার ভিত্তিতে। ‘মুনাফা বেশি হলে বেশি কর, না হলে কর নয়—এটাই ন্যায্য,’ বলেন তিনি।

ন্যূনতম করের প্রস্তাবিত বৃদ্ধি নিয়েও ব্যাপক আপত্তি এসেছে। এ প্রসঙ্গে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও কর বিশেষজ্ঞ স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, ‘ধরা যাক, কারও টার্নওভার ১০০ কোটি টাকা, কিন্তু মুনাফা অনেক কম। এক্ষেত্রে ২৭.৫ শতাংশ হারে কর ধরলে ৫০ লাখ টাকা হয়, কিন্তু ১ শতাংশ ন্যূনতম কর ধরলে দিতে হবে ১ কোটি টাকা; মানে কার্যকর করহার দাঁড়াচ্ছে ৫৫ শতাংশ।’

স্নেহাশীষ বড়ুয়া আরও বলেন, লোকসান করা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এই কর ‘মূলধন-খেকো’ হয়ে উঠবে। কারণ, মুনাফা না হলেও পুরো কর গুনতে হবে মূলধন থেকে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে নিবন্ধিত ২ লাখ ৮৮ হাজার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ২৪ হাজার ৩৮১টি রিটার্ন জমা দিয়েছে। তার মধ্যে ৮ হাজারের মতো কোম্পানি প্রকৃতপক্ষে ন্যূনতম কর পরিশোধ করছে। এনবিআর কর্মকর্তাদের ভাষায়, ‘এই পরিবর্তনের চাপে মূলত ওই ৮ হাজার প্রতিষ্ঠানের ওপরই বাড়তি চাপ পড়বে।’

তবে করদাতাদের জন্য একটিমাত্র স্বস্তির দিক হতে পারে, তা হলো ন্যূনতম কর সমন্বয়ের সুযোগ থাকছে ভবিষ্যৎ করবর্ষে ‘ক্যারি ফরোয়ার্ড’ করার মাধ্যমে।

এ নিয়ে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মোহাম্মদ জাভেদ আখতার বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম ন্যূনতম কর ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হবে। বরং সেটি বাড়িয়ে আরও চাপ বাড়ানো হচ্ছে। এটি ভুল সিদ্ধান্ত, বিশেষ করে সৎ, ক্ষুদ্র ও নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য।’

বর্তমানে ন্যূনতম করহার পাঁচ ধরনের ব্যক্তি ও কোম্পানির ওপর ধার্য রয়েছে, যা শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ পর্যন্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ ৫ শতাংশ কর গুনতে হয় কার্বোনেটেড বেভারেজ কোম্পানিগুলোকে। তামাক কোম্পানির ক্ষেত্রে এই হার ৩ শতাংশ এবং মোবাইল ফোন অপারেটরদের জন্য ২ শতাংশ। যেসব ব্যক্তি করদাতার বার্ষিক টার্নওভার ৩ কোটি টাকার বেশি, তাঁদের জন্য ন্যূনতম করহার নির্ধারিত আছে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ। এ ছাড়া অন্যান্য কোম্পানিকে শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ এবং রপ্তানিকারকদের ক্ষেত্রে ১ শতাংশ হারে ন্যূনতম কর দিতে হয়।

ন্যূনতম কর পুরোপুরি বাতিলের পরামর্শ দিয়েছেন এনবিআরের আরেক সাবেক সদস্য আমিনুর রহমান। তার ভাষায়, ‘মাথাব্যথায় মাথা কেটে ফেলা সমাধান হতে পারে না। সৎ করদাতাদের শাস্তি দিয়ে অসৎদের ফাঁকি পূরণ করা উচিত নয়।’





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত