আমার তখন বয়স অল্প। শৈশব আর কৈশোরের মাঝামাঝি সময়। সে সময় হঠাৎ একদিন একটা বই উপহার পেলাম একজন থেকে। আনোয়ারা সৈয়দ হকের ‘আমার মা সবচেয়ে ভালো’। এ বইয়ের মূল চরিত্র টুম্পা নামের ছোট্ট একটি মেয়ে। ছোট্ট টুম্পার জীবনের কেন্দ্রবিন্দু তার মা। আমার মায়ের দিকে তাকালে মনে হয়, আমার মা-ই যেন দুনিয়ার সেরা মা!
পুতুল নিয়ে খেলার বয়সী শিশু টুম্পা বেশি কিছু বোঝে না, তার পৃথিবী বলতে শুধু তার মা। টুম্পার চোখে তার মা সবচেয়ে সুন্দর। মায়ের ভেজা চুল, কাজের ফাঁকে ঘর্মাক্ত লাবণ্যময় চেহারা- সবকিছুই তার কাছে মনোমুগ্ধকর, অপরূপ। তার মায়ের সৌন্দর্য তার কাছে ধরা দেয় নানারূপে। শুধু তাই না, মায়ের মুখে বড় হওয়ার জন্য নিয়মিত দুধ খাওয়ানোর আবদার, তার মায়ের সঙ্গে বনভোজন করা, তার একটা প্রবল ইচ্ছা গাছ-ঘর তৈরি করার স্বপ্নপূরণ- সবকিছু তার মা পূরণ করে। টুম্পার কাছে তাহলে কি তার মা-ই সবচেয়ে ভালো হবে না!
এবার আমার মায়ের কথা বলি। আমার যখন দুই বা তিন বছর বয়স, সবে হাঁটি হাঁটি পা পা করে চলা শিখছি। আম্মু আমাকে তখন রাজহাঁস দেখানোর কথা বলে ভাত খাইয়ে দিতেন, পাখির সাথে কথা বলা শিখাতেন, প্রজাপতির ডানা ধরলে ওরা ব্যথা পাবে এসব মধুর গল্পে গল্পে কখন যে খাওয়া শেষ হয়ে যেত টেরই পেতাম না। এরপর আমি বড় হলাম। এখনো যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরি, আমার ক্লান্ত শরীর, মন নিয়ে, আমার জানা থাকে, বাসায় আমার জন্য একজন অপেক্ষা করে আছে হয়তো একটু ঠান্ডা শরবত নিয়ে, হয়তো সিজনাল কোনো ফল নিয়ে, সেমাই, পায়েস বা আমার পছন্দের কোনো খাবার নিয়ে। এরপর যখন এসে আম্মুর হাতের অপূর্ব রান্নার স্বাদ নিতে টেবিলে বসি, মনে হয় সেই ছোটবেলার রাজহাঁস দেখানোর মতো আমার সময় কেটে যায়। বুঝতেই পারি না কখন যেন খাওয়া শেষ হয়ে গেল!
আমি কখনো আমার মায়ের জন্মদিন পালন করিনি। কিন্তু একবার, যখন আমি আরও ছোট, তখন শখ করে আম্মুর এক জন্মদিনে সারা বাজার ঘুরে একটা আংটি পছন্দ করে নিয়ে এলাম। সেই ছোটবেলার টিফিনের টাকা জমিয়ে কেনা সাদামাটা একটা আংটি। বাসায় ফিরে যখন সেটা আম্মুর চোখ বন্ধ রাখার শর্তে হাতে দিলাম, চোখ খুলে একটা চাঁদমাখা হাসি দিয়ে আংটিটা পরে নিলেন। আজও মনে পড়ে, ওই একটা আংটি পছন্দ করতে গিয়ে তপ্ত গরমে সারা বাজার ঘুরেছি। যখনই আম্মুর মুখের সেই অমলিন হাসি দেখলাম, আমার সব ক্লান্তি যেন সার্থক হয়ে উঠল সেদিন।
মায়েদের কাছে মনে হয় রূপকথার কোনো জাদুর কাঠি থাকে। এই কাঠির ছোঁয়াতেই সম্ভবত আমার হাসি-কান্না, ব্যথা, আনন্দ, মন খারাপ, অভিমান, অভিযোগ সবকিছু আম্মু টের পেয়ে যায়। নাহলে যেদিন আমি সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা নিয়ে নিপুণ কৌশলে আম্মুর সাথে অতি স্বাভাবিক স্বরে কথা বলছিলাম, আম্মু কীভাবে বুঝল আমি ভালো নেই! কীভাবে বললো, ‘আমার মন কেমন করে! তুই কি সুস্থ আছিস!’ সেদিন আমি বিশ্বাস করেই নিয়েছিলাম, আমাদের থেকে লুকিয়ে নিশ্চয়ই আম্মু কোনো জাদুর কাঠি ব্যবহার করে।
সেই রাজহাঁস দেখা মেয়েটা থেকে কত বড় হয়েছি আমি। মায়ের আঙুল ধরে রাস্তা পার হওয়া আমি এখন একাই রাস্তা পার হই। কত আদর, ভালোবাসা, রাগ, অভিমান, খুনসুটির সাথে দিনগুলো কেটে গেল। আমি বড় হলাম, কিন্তু আমার মা এখনো সেই ছোটবেলার মা-ই রয়ে গেছে। ছোটবেলায় মায়ের সাথে একটু দুষ্টুমি করে যেমন খিলখিল করে হেসে দিতাম, এখনও সেভাবেই হাসি। মায়ের হাসিও তেমনই নির্মল, অমলিন, সেই ছোটবেলার মতোই। এমন হাসি দেখার জন্য, মায়ের ছোট থেকে বড় স্বপ্ন পূরণের জন্য মা হাজার বছর বেঁচে থাকুক। একদিন যখন অনেক বড় হবো, আমার স্বপ্ন পূরণ করে স্টেজে আম্মুকে হাত বাড়িয়ে সাথে নিয়ে সেদিন ঘোষণা করব, টুম্পার মা নয়, আমার মা-ই সবচেয়ে ভালো।
লেখক : শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়