Homeদেশের গণমাধ্যমেভারতে পণ্য রপ্তানিতে অতিরিক্ত কত পথ পাড়ি দিতে হবে?

ভারতে পণ্য রপ্তানিতে অতিরিক্ত কত পথ পাড়ি দিতে হবে?


স্থলবন্দর দিয়ে কয়েকটি প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য, ড্রিংস ও তৈরি পোশাক আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত। এতদিন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা কম সময়ে খুব সহজে স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য পাঠাতে পারতেন। নিষেধাজ্ঞার ফলে একই পণ্য পাঠাতে চার থেকে ১৫ গুণের বেশি পথ পাড়ি দিতে হবে। খরচও বাড়বে চার-পাঁচ গুণ।

ঠিক কত কিলোমিটার পথ অতিরিক্ত পাড়ি দিতে হবে তা নিয়ে চলছে আলোচনা। আর বাড়তি পথ পাড়ি দিলে যে সময়-ব্যয় বাড়বে সেটা রপ্তানিকারকদের জন্য কতটা চাপের কিংবা আদৌ এভাবে পণ্য পাঠানো সম্ভব কি না সেটা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। সার্চ ইঞ্জিন গুগলের সহায়তা নিয়ে সম্ভাব্য অতিরিক্ত দূরত্ব বের করার চেষ্টা করেছে জাগো নিউজ।

রপ্তানিপণ্য পাঠাতে আগে যত পথ পাড়ি দিতে হতো

নিষেধাজ্ঞার আগে দেশের প্রধান রপ্তানিপণ্য তৈরি পোশাক ভারতে যেত মূলত ঢাকা থেকে বেনাপোল স্থলবন্দর হয়ে কলকাতায়। এই স্থলপথের দূরত্ব প্রায় ৩৩৩ কিলোমিটার। এখন যেতে হবে সমুদ্রপথে। সেক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে পণ্য পাঠালে ভারতের মুম্বাইয়ের নভো সেবা বন্দর অথবা ঢাকার পানগাঁও কিংবা মংলা বন্দর হয়ে কলকাতার হলদিয়া বন্দর পৌঁছাতে হবে।

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে নৌপথে মুম্বাইয়ের নভো সেবা বন্দরের দূরত্ব প্রায় দুই হাজার ৬৫০ নটিক্যাল মাইল। পানগাঁও কিংবা মংলা থেকে কলকাতার হলদিয়ার দূরত্ব প্রায় ৭০ থেকে একশ নটিক্যাল মাইল। পণ্য বন্দরে পৌঁছালে তারপর সেখান থেকে সেভেন সিস্টার্স কিংবা অন্য গন্তব্যে যেতে হবে আলাদা পরিবহনের মাধ্যমে। এতে প্রায় সপ্তাহখানেক সময় লাগবে, যা আগে একদিনে করা যেত স্থলবন্দরের মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে স্থলপথের তুলনায় খরচ বাড়বে কয়েক গুণ। সময়ও লাগবে বেশি। এমনটাই বলছেন রপ্তানিকারকরা।

বেনাপোল দিয়ে যদি রপ্তানি বন্ধ হয়, ভারত যদি কাপড় আমদানি বন্ধ করে তাহলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে আমাদের। ভারতের সঙ্গে আমরা কঠিন প্রতিযোগিতা করে তৈরি পোশাক রপ্তানি করি। বেনাপোল দিয়ে রপ্তানি বন্ধ হলে আমাদের খরচ অনেক বেড়ে যাবে।- বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান

তৈরি পোশাক ছাড়াও স্থলবন্দর ব্যবহার করে খুব সহজে, কম সময়ে কম পথ পাড়ি দিয়ে কেক, চিপস, বিস্কুট, আসবাব, ড্রিংকস ও প্লাস্টিকপণ্য যেত ভারতে। সরাসরি রুটগুলো ছিল- ঢাকা-বাংলাবান্ধা-শিলিগুড়ি (পশ্চিমবঙ্গ)— দূরত্ব প্রায় ৪৭৫ কিমি, ঢাকা-বুড়িমারী-কোচবিহার (পশ্চিমবঙ্গ)— দূরত্ব প্রায় ৪৫১ কিমি, ঢাকা-আখাউড়া-আগরতলা (ত্রিপুরা)— দূরত্ব প্রায় ১২৮ কিমি, ঢাকা-চাতলাপুর-করিমগঞ্জ (আসাম)— দূরত্ব প্রায় ৩০৮ কিমি, ঢাকা-শেওলা-করিমগঞ্জ (আসাম)— দূরত্ব প্রায় ২৮৮ কিমি এবং ঢাকা-তামাবিল-শিলং (মেঘালয়)-গৌহাটি (আসাম)—দূরত্ব প্রায় ৪৬৮ কিমি।

এখন যত পথ পাড়ি দিতে হবে

নতুন নিষেধাজ্ঞার ফলে ঘুরে যেতে হবে বেশ লম্বা পথ। অতিরিক্ত পাড়ি দিতে হবে প্রায় চার থেকে ১৫ গুণ বেশি পথ। এখন যদি রপ্তানিকারকরা স্থলপথে পণ্য পরিবহন করতে চান সেক্ষেত্রে ঢাকা-ভোমরা-কলকাতা-শিলিগুড়ি-গৌহাটি-করিমগঞ্জ-আগরতলা (১ হাজার ৯শ কিমি প্রায়) কিংবা ঢাকা-সোনামসজিদ-শিলিগুড়ি-গৌহাটি-করিমগঞ্জ-আগরতলা (প্রায় ১ হাজার ৬শ কিমি প্রায়) হয়ে তবেই পৌঁছাতে হবে।

এতে যে কার্গো পরিবহনের ভাড়া বাংলা ২০ হাজার টাকা লাগতো সেটা এখন এক লাখ বা তার বেশি পড়বে। এত বেশি টাকা খরচ করে রপ্তানিকারকরা রপ্তানি কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া নিয়ে শঙ্কায় আছেন।

তারা বলছেন, স্থলবন্দর বন্ধ হলে ভারতে পণ্য রপ্তানি মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। কারণ, বিকল্প হিসেবে সমুদ্রপথে বাড়বে খরচ ও সময়। সমুদ্রবন্দর দিয়ে ভারতের কলকাতা ও মুম্বাই বন্দরে পণ্য খালাস করে স্থলপথে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে যেতে হবে। এতে মূল ভূখণ্ডে কিছুটা রপ্তানি হলেও সবচেয়ে বড় বাজার সেভেন সিস্টার্স খ্যাত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে পণ্য পাঠানো প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে।

আরও পড়ুন

বেশ কয়েকজন রপ্তানিকারক জানান, এর আগে তারা সব সময় ভারতের স্থলবন্দর ব্যবহার করেই পণ্য রপ্তানি করেন। কখনো সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করেননি। কারণ এতে পরিবহন খরচ প্রায় পাঁচগুণ হয়। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ওই সব রাজ্যে পণ্য পাঠাতে প্রথমে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে সমুদ্রপথে কলকাতায় পণ্য পাঠাতে হবে। পরে পুরো বাংলাদেশের সীমান্ত ঘুরে আসাম, মেঘালয়, করিমগঞ্জ ও আগরতলায় যাবে পণ্যের চালান।

তৈরি পোশাক রপ্তানির জন্য মূলত ঢাকা-বেনাপোল-কলকাতা রুট ব্যবহার করা হতো। নিষেধাজ্ঞায় ব্যাপক সংকটে পড়বেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।

স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বেনাপোল দিয়ে যদি রপ্তানি বন্ধ হয়, ভারত যদি কাপড় আমদানি বন্ধ করে তাহলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে আমাদের। ভারত নিজেও পোশাক উৎপাদন করে। ভারতের সঙ্গে আমরা কঠিন প্রতিযোগিতা করে তৈরি পোশাক রপ্তানি করি। বেনাপোল দিয়ে রপ্তানি বন্ধ হলে আমাদের খরচ অনেক বেড়ে যাবে। ভারতে তৈরি পোশাকের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অনেক ভালো।’

এখন অন্যভাবে (সমুদ্রপথে) রপ্তানি করার সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশি কোম্পানি খরচ পোষাতে পারবে না। কারণ আমরা আগে বর্ডার পার হলেই আসাম, গৌহাটি, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামে পণ্য পৌঁছাতে পারতাম স্থলপথে। ওই পথে না গেলে নৌপথে অনেক ঘুরে, বারবার ট্রান্সপোর্ট পরিবর্তন করে খরচে টিকতে পারবো না।- ড্যানিশ ফুডের হেড অব বিজনেস দেবাশীষ সিংহ

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এতদিন রপ্তানিকারকরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, মৌলভীবাজারের চাতলাপুর, সিলেটের শেওলা, তামাবিল স্থলবন্দরের মতো ছয়টি বন্দর দিয়ে ভারতের সেভেন সিস্টার্সে পণ্য পাঠিয়েছে। এতে ২০ ফুটের একটি কার্গোর জন্য ভাড়া গুনতে হয়েছে ১৮ থেকে ২৫ হাজার টাকা। যেখানে এখন একই ভাড়া দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত পণ্য নেওয়া যাবে। এরপর অতিরিক্ত জাহাজ ভাড়া ও কলকাতা থেকে আবারও পণ্য আসাম, মেঘালয়, করিমগঞ্জ বা আগরতলায় নিতে প্রায় এক লাখ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হবে।

নতুন সিদ্ধান্তে ভারতে খাদ্যপণ্য রপ্তানি মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে জানিয়ে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্থলপথে পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞার কারণে কার্যত ভারতের সঙ্গে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ নৌপথে পণ্য পরিবহন বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোর জন্য প্রতিযোগিতামূলক হবে না। খরচের পাশাপাশি সময়ের কারণে আমরা পারবো না। আবার সব জায়গায় নৌপথে পণ্য যাবেও না। বিশেষ করে সবচেয়ে বড় বাজার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সে সুযোগ নেই।’

ড্যানিশ ফুডের হেড অব বিজনেস দেবাশীষ সিংহ জাগো নিউজকে বলেন ‘এখন অন্যভাবে (সমুদ্রপথে) রপ্তানি করার সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশি কোম্পানি খরচে পোষাতে পারবে না। কারণ আমরা আগে বর্ডার পার হলেই আসাম, গৌহাটি, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামে পণ্য পৌঁছাতে পারতাম স্থলপথে। ওই পথে না গেলে নৌপথে অনেক ঘুরে, বারবার ট্রান্সপোর্ট পরিবর্তন করে খরচে টিকতে পারবো না।’

বাংলাদেশ প্লাস্টিকপণ্য প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিপিজিএমইএ) সভাপতি সামিম আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এত খরচ করে সমুদ্রপথে পণ্য নিয়ে সেটা কোনোভাবে প্রতিযোগিতা সক্ষম হবে না। আগে কখনো সমুদ্রপথে আমরা পণ্য পাঠাইনি। এখন সেটা করতে হলে আমাদের পণ্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে। দেশ থেকে প্রায় ৫০টির বেশি কোম্পানি শুধু প্লাস্টিকপণ্য রপ্তানি করতো, সেগুলো একটি বড় বাজার হারাবে।’

বিষয়টি সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকেও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সরকার চেষ্টা করছে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে সমাধানের। এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব মো. মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভারত যে পদক্ষেপ নেওয়ার সেটা আলাপ-আলোচনা ছাড়াই নিয়েছে। তারা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেজন্য আমরা যে আবার আরেকটা পাল্টা নিষেধাজ্ঞা দেবো, সেটা ভাবছি না। আমরা চিন্তা-ভাবনা করে আলোচনায় যেতে চাচ্ছি ভারতের সঙ্গে। আমরা আমাদের রপ্তানির ক্ষতির মাত্রা নির্ধারণ করছি এখন। তারপর কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেবো।’

এএসএ/এমএফএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।



Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত