মৌলভীবাজারের চা বাগানগুলোতে সূর্য উঠতেই শুরু হয় শ্রমের কঠিন অধ্যায়। প্রতিদিন ঝরে হাজারো শ্রমিকের ঘাম। চা শ্রমিকদের জীবন যেন কঠিন সংগ্রামের এক দীর্ঘ ইতিহাস। সবুজ গালিচার ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে শ্রমিকদের অধিকারহীন জীবনের গল্প।
তেমনই একজন চা শ্রমিক ধনা সনি। কাজের ফাঁকে হাতে নিয়েছেন সাদা রুটি আর কাঁচা পাতা, এটিই তার দুপুরের নীরব আহার। এভাবে সবুজ চা-বাগানের বুক চিরে চলে তাদের জীবন সংগ্রাম।
শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগানে কাজ করা ধনা সনি বলেন, ‘সপ্তাহে পাই মাত্র এক হাজার টাকা। এসবে আমাদের কেমনে পোষাইবো। এই বৃদ্ধ বয়সে কাজ করি। সপ্তাহে যা মজুরি পাই তা থেকেও কেটে রাখে রেশন, ভাতা আরও অনেক ফান্ডের টাকা। বেশি তো আর পাই না। আমাদের দুঃখতো আর কেউ শুনে না, কেউ বুঝতেও চায় না।’
ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হয় চা শ্রমিকদের। একমুঠো মুড়ি আর এক কাপ চা খেয়ে কাজে নেমে পড়েন শ্রমিকরা। কাঠফাটা রোদে দিনভর সংগ্রহ করেন চা পাতা। দুপুরে এক ফাঁকে চা পাতার চাটনি মেখে ভাত খান, কখনো সঙ্গে থাকে মুড়ি কিংবা চানাচুর। এভাবেই কাটে চা শ্রমিকের জীবন। বৃষ্টিতে ভিজে, খালি পায়ে, জোক আর বিষাক্ত সাপের সঙ্গে যুদ্ধ করে চা বাগানকে আঁকড়ে জীবন পার করছেন তারা। দুটি পাতা একটি কুঁড়িবেষ্টিত চা বাগানের সীমানাতেই আটকে আছে তাদের জীবন।
বংশ পরম্পরায় যে জমিতে চা শ্রমিকরা বসবাস করেন, সেই জমির ওপর কখনোই মেলে না অধিকার। তাই মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু ধরে রাখতে হলে পরিবারের কাউকে না কাউকে বাগানে কাজ করতেই হয়। দিনশেষে ২৩ কেজি পাতা তুললেই পূরণ হয় মাথাপিছু লক্ষ্যমাত্রা। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলেই ‘হাজিরা’ হিসেবে গণ্য করা হয়। গাছ ছাঁটার সময় সারা দিনে অন্তত ২৫০টি চা গাছ ছাঁটতে হয়। কীটনাশক ছিটানোর বেলাতেও সারা দিনে অন্তত ১ একর জমিতে কীটনাশক ছিটানোর লক্ষ্যমাত্রার বোঝা কাঁধে নিয়ে কাজ করতে হয় তাদের।
প্রত্যেক বছর শ্রমিক দিবস এলে ঘটা করে পালন করা হয় দিনটি। কিন্তু চা বাগানের শ্রমিকরা তাদের জীবনচক্র আটকে ফেলেছেন চা বাগানের গণ্ডির মধ্যেই। দৈনিক ৮ থেকে ১০ ঘণ্টার কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে মেলে সামান্য মজুরি।
দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, কম মজুরি, আর মৌলিক সুযোগ-সুবিধার অভাবে কাটে চা শ্রমিকদের জীবন। শিক্ষা ও চিকিৎসা এখনো রয়ে গেছে স্বপ্নের বাইরে। সারা দিনের কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে হাতে আসে সামান্য কিছু মজুরি। তা দিয়েই নূন আনতে পান্তা ফুরায়।
জগছাড়া চা বাগানের শ্রমিক মিনি হাজরা বলেন, যা মজুরি পাই এর থেকে কয় টাকা বাঁচে। সন্তানদের ঠিকমতো লেখাপড়া করাইতে পারি না। এখন তারা শহরে মানুষের রিকশা চালায়।
চা শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের চা শ্রমিকদের সর্বশেষ মজুরি পরিস্থিতি অনুযায়ী ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত দৈনিক মজুরি ১৭৮.৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই মজুরি বৃদ্ধির হার বার্ষিক ৫% হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে। তবে চা শ্রমিক নেতারা এই বৃদ্ধি অপ্রতুল মনে করে দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরির দাবি জানিয়েছেন।
এর আগে ২০২২ সালের আগস্টে চা শ্রমিকদের আন্দোলনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে ১৭০ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছিল। চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে মজুরি বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। বর্তমানে অনেক শ্রমিক নিম্ন মজুরিতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এবং তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছেন বলেন জানান শ্রমিক নেতারা।
বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি পঙ্কজ কন্দ জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে চা শ্রমিকদের ঘরে ঘরে বেকরাত্বের ছাপ। সরকার যদি বাংলাদেশের নির্ধারিত স্থানে কারিগরি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে তাহলে বেকারত্ব দূর হবে। সবাইতো বাগানে কাজ করতে পারে না। প্রত্যাশা করি চা জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ যাবতীয় দাবিগুলো সরকার পূরণ করবে। শ্রম আইনে অনেক বৈষম্য রয়েছে, আমরা বিশ্বাস করি এই সরকার ভূমি অধিকারসহ শ্রম আইন সংস্কার করবে।
বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা জাগো নিউজকে বলেন, সারাদেশের প্রায় ৭০টি বাগান বর্তমানে হেয়প্রতিপন্ন অবস্থায় আছে। এই বাগানগুলো যেমন রীতিমতো চলছে না, তেমনি শ্রমিকরা কাজ করছে কিন্তু মজুরি পাচ্ছে না। যার কারণে শ্রমিকরা অসহায় জীবন যাপন করছেন। এবারের মে দিবসে সরকারের কাছে দাবি থাকবে, আমাদের বাসস্থান, মজুরি, শিক্ষা, চাকরি নিশ্চিত করতে হবে। বৈষম্যের শিকার চা শ্রমিকরা পিছিয়ে পড়া জাতি। দেশের সবচেয়ে নিপীড়িত ও অবহেলিতও বলা যায়।
তবে শ্রমিকদের মজুরি কম হলেও আবাসন, চিকিৎসা, রেশনের মতো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশি চা সংসদ সিলেট অঞ্চলের সভাপতি গোলাম মোহাম্মদ শিবলি জাগো নিউজকে বলেন, শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি কম হলেও চা বাগান মালিকরা তাদের থাকার ব্যবস্থা, চিকিৎসা, রেশন ইত্যাদির মতো সুযোগ-সুবিধা সরবরাহ করে, যা অর্থের দিক দিয়ে পরিমাপ করা হয় না। সব সুযোগ-সুবিধা হিসাব করলে তাদের মাসিক মজুরি ১২-১৫ হাজার টাকা হয়, যা অন্য শিল্পের চেয়ে বেশি। সব কিছুর দাম বেড়েছে, শুধু চা বাদে। অধিকাংশ বাগান মালিক লোকসানে রয়েছেন। অনেক বাগান মালিক শ্রমিকের মজুরি দিতে পারছেন না। এভাবে চলতে থাকলে এই শিল্পের ভবিষ্যৎ ভালো হবে না।
টি প্লেন্টার্স অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও এমআর খান চা বাগানের মালিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ১০ বছর আগে চায়ের কেজি যা ছিল আজও তাই। কিন্তু এই সময়ে শ্রমিকদের মজুরি ৭০ ভাগ বাড়ানো হয়েছে। এটা সবাইকে স্বীকার করতেই হবে, চা বিক্রি করে যে লাভ আসবে সেটা দিয়ে শ্রমিকদের বেতন, বাগানের খরচ সব কিছু দিয়েই বাগান চালাতে হবে। এখানে ভর্তুকি দেওয়ার সুযোগ নেই। খরচ বেশি, কিন্তু চায়ের দাম কম।
এফএ/এএসএম