Homeবিনোদনঅফিস, বাড়ি আর নিজের সন্তানের বাইরে কিছু ভাবতে মানুষ ভুলে গেছে: শাশ্বত...

অফিস, বাড়ি আর নিজের সন্তানের বাইরে কিছু ভাবতে মানুষ ভুলে গেছে: শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়


প্রথমবার বাংলাদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কেমন হলো?

এর আগে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ফ্লাই করে গেছি, কিন্তু কখনো যাওয়া হয়নি। ছোটবেলায় অ্যান্টেনার সঙ্গে বুস্টার লাগালে কলকাতা থেকে বিটিভি দেখা যেত। সেই সূত্রে বাংলাদেশের টেলি নাটকের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। সুন্দর সুন্দর নাটক হতো, সেগুলো দেখতাম। এবার প্রথমবার যখন নামি ঢাকা এয়ারপোর্টে, অদ্ভুত এক্সপেরিয়েন্স হলো। ইমিগ্রেশনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, সেখানে যিনি ছিলেন তিনি ‘ক্যামেরার দিকে তাকান’ বলে আমার দিকে তাকিয়ে ফিক্সড হয়ে গেলেন। সঙ্গে একগাল হাসি। বাংলাদেশে ঢোকার একটু আগে, আপনাদের এয়ারপোর্টে আর্মির একটা বেজ আছে, ছোট অফিস গোছের। সেখানে দুজন ইউনিফর্ম পরা ভদ্রলোক এসে বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’ আমি বললাম, শুটিং করতে। বললেন, ‘দেশে তো ঢুকতে দেব না।’ আমি বললাম, মানে? আমি এত দূর থেকে আসছি। বললেন, ‘এখানে তো এক কাপ চা না খেয়ে আপনি দেশে ঢুকতে পারবেন না।’ এভাবে বাংলাদেশে আমার এন্ট্রি হলো। এরপর পুরো সময়টা স্বপ্নের মতো কেটেছে।

শারীরিকভাবে এ দেশে প্রথম এলেও এখানকার মানুষের মনে আপনি আরও আগেই জায়গা করে নিয়েছেন, আপনার কাজ দিয়ে…

এটা তো ভাগ্যের ব্যাপার। সত্যি বলতে, এত বছর ধরে কোনো ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকাটা খুবই মুশকিল। যদি না আপনি আপনার ১০০ শতাংশ দেন আপনার কাজের পেছনে। সেটা আমি করার চেষ্টা করেছি, ফাঁকি মারিনি, তার ফল আমি বুঝতে পেরেছি বাংলাদেশের মাটিতে নেমেই।

‘গুলমোহর’ সিরিজের শুটিং করে কেমন লাগল?

খুবই সুন্দর একটা সাবজেক্ট। এ ধরনের কাজ আমাদের এখানে সত্যিই খুব কম হয়। পুরোনো ফ্যামিলির ঐতিহ্য, তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড—সব মিলিয়ে চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা। প্রথমবার অন্য দেশের এত বড় বড় শিল্পীর সঙ্গে কাজ, আমি একটু গুটিয়েই ছিলাম। কিন্তু বাকিরা এত সুন্দরভাবে আমাকে অ্যাকসেপ্ট করে নিয়েছেন, এত সহজ করে তুলেছেন যে একবারের জন্যও মনে হয়নি আমি দেশের বাইরে কাজ করছি।

গুলমোহরে অভিনয়ের ক্ষেত্রে আপনার আগ্রহের প্রধান বিষয় কী ছিল?

আমার তো প্রথমেই লোভ লেগেছিল যে বাংলাদেশে গিয়ে এ রকম একটা গল্পে অভিনয় করব, যেটা কোনো দিন করা হয়নি। বাংলাদেশে এত পুরোনো সুন্দর সুন্দর লোকেশন দেখলাম! এত সবুজে ঘেরা জায়গা! এত ওয়ার্ম হার্টেড মানুষজন! আমরা গিয়েছিলাম মাওয়া বলে একটা জায়গায়। জ্যান্ত ইলিশ দেখে পছন্দ করে একদিন সন্ধ্যাবেলা খাওয়াদাওয়া করেও এসেছি। যে পদ্মা নদীর কথা আমরা এত দিন শুনে এসেছি, চোখের সামনে অত বড় একটা নদী! অদ্ভুত লাগছিল! যেটা টাকি শহর থেকে আমরা দেখি। আমরা যখন টাকির এপারে থাকি, ভারতবর্ষে থাকি, তখন অদ্ভুত লাগে। টাকির এদিকে দাঁড়ালে ওদিক থেকে আজানের শব্দ আসে। আর এবার দেশটার ভেতরে দাঁড়িয়ে সেসব দেখলাম, এ অভিজ্ঞতা বলে বোঝানো যাবে না।

বাংলাদেশে এত পুরোনো সুন্দর সুন্দর লোকেশন দেখলাম! এত সবুজে ঘেরা জায়গা! এত ওয়ার্ম হার্টেড মানুষজন! আমরা গিয়েছিলাম মাওয়া বলে একটা জায়গায়। জ্যান্ত ইলিশ দেখে পছন্দ করে একদিন সন্ধ্যাবেলা খাওয়াদাওয়া করেও এসেছি। যে পদ্মা নদীর কথা আমরা এত দিন শুনে এসেছি, চোখের সামনে অত বড় একটা নদী! অদ্ভুত লাগছিল!

নির্মাতা সৈয়দ আহমেদ শাওকী খুব বেশি কাজ বানাননি, সেই অর্থে তিনি নতুন। তাঁর পরিচালনায় ভরসা রাখার কারণ কী?

আমাকে আগেই বলা হয়েছিল, উনি নতুন হতে পারেন, কিন্তু কাজটা জানেন। একটা ধারা উনি নিয়ে এসেছেন, যেটা এর আগে হয়তো সেভাবে কেউ করেননি। সেটা কাজ করতে করতে বুঝতে পারলাম, উনার মাথা একদম পরিষ্কার, কী চান কী চান না, উনি জানেন। এ ধরনের ডিরেক্টর পাওয়াটা আজকের দিনে দুষ্কর।

গুলমোহরের মতো পারিবারিক ইমোশনের গল্প এখন অনেক কম হচ্ছে, এ কথা আপনি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন। এর কারণ কী?

এখন এত নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি হয়ে গেছে! মানুষ অফিস, বাড়ি আর নিজের সন্তানের বাইরে কিছু ভাবতে ভুলে গেছে। এই যে ফ্যামিলির একটা ঐতিহ্য, এই যে আমার আজকে ঠাকুরদাদা যেমন আছেন, ঠাকুরদাদার ছোট ভাইও আমার সঙ্গে আছেন। আমার পিসিমা বিধবা হয়ে যাওয়ার পরে বাড়িতে চলে এসেছেন, তিনিও আছেন। এই যে বন্ডিংগুলো, সেগুলো তো এখন ফ্যামিলি থেকেই হারিয়ে যাচ্ছে। কাজেই ইমোশনও হারাবে।

তাহলে নতুন প্রজন্মের কাছে গুলমোহর সিরিজটি কি ততটা ইমোশনাল হয়ে উঠতে পারবে?

যাদের মন আছে, তাদের কাছে পারবে। যারা ভাবতে পারে, চিন্তা করতে পারে, যারা শুধুই টাকার পেছনে ছুটছে না, সাকসেসের পেছনে ছুটছে না। সে রকম মানুষও তো আছে। সিরিজটা তাদেরকে ছোঁবে। আমি বিশ্বাস করি, সবাইকে কোনো দিন খুশি করা যায় না। কেউ কোনো দিন পারেননি। আমি এমনও শুনেছি, উত্তমকুমারের থেকে অমুক বেটার অ্যাক্টর, অমিতাভ বচ্চন কোনো অ্যাক্টরই নন—এ রকম বলার লোকও আছেন। কাজেই সবাইকে কেউ কোনো দিন খুশি করতে পারেনি। আমিও পারব না। কাজেই যত বেশিসংখ্যক দর্শক আমরা পাব, সেটাই আমাদের লক্ষ্য। আমার মনে হয়, সে ধরনের মানুষ এখনো আছে বলেই পৃথিবীটা চলছে, পারস্পরিক সম্পর্ক, মূল্যবোধ যাদের কাছে খুব ইমপরট্যান্ট।

আপনি একটা সমৃদ্ধ শৈশব পেয়েছেন। আপনার বাবা বিখ্যাত অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের কারণে ওই সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতাদের সান্নিধ্য পেয়েছেন। এটা আপনার জীবনকে প্রভাবিত করেছে?

বাংলায় একটা কথা আছে জানেন তো, গেয়ো যোগী ভিখ পায় না। ছোটবেলায় এদের কোনো দিন পাত্তা দিইনি, বিশ্বাস করুন। উত্তমকুমার কে, সেটা আমি চিনেছি তিনি মারা যাওয়ার পরে। তখন আপামর ভারতবাসী কান ঢাকছেন, অমিতাভ বচ্চন এসে গেছেন। কিন্তু উত্তম জেঠু চলে যাওয়ার পর আমি কলকাতার রাস্তায় যে পরিস্থিতি দেখেছিলাম, তারপর আমার জানতে ইচ্ছে করেছিল উনি কে! এ তো উত্তম জেঠু, বাবাও শুটিং করেন, উনিও শুটিং করেন। সিনেমা করেন। উনি আলাদা কী!

ছোটবেলায় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোলে বসা আমার একটা ছবি আছে, কিন্তু ওটা কোনো দিনই আমার কাছে ইমপরট্যান্ট ছবি বলে মনে হয়নি। ও তো ভানু জেঠু, এ তো উত্তম জেঠু, এ তো সৌমিত্র জেঠু, সাবিত্রী পিসি! পরে তো এদের দেখেই আমি যা শেখার শিখেছি। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট সিনেমা দেখেই অভিনয় শিখেছি। এবং কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো চরিত্রে তাঁদের কোনো না কোনো ইনফ্লুয়েন্স থেকে যাবেই। প্রভাব কিছু থাকবেই। যাঁরা খুব বড়, কোনো কোনো বিষয়ে তাঁদের থেকে বেরিয়ে গিয়ে কিছু করা যায় না। কোথাও না কোথাও একটা ছাপ থেকে যায়। উত্তম জেঠু একবার বলেছিলেন, ‘জমিদারের চরিত্র করব, অথচ ছবি বিশ্বাস ঢুকে থাকবে না মনে, এটা তো হতে পারে না।’ আমি কমেডি করব, কোথাও একটা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, জহর রায়, তুলসী চক্রবর্তী ঠিক বেরিয়ে যাবে। কিন্তু সেটা কখনোই অনুকরণ নয়। অনুসরণ করতে করতে কোথাও ভেতরে থেকে যায়।

আপনি বেশ কিছু বায়োপিক করেছেন। তবে ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় নীলকণ্ঠ বাগচী মানে ঋত্বিক ঘটকের চরিত্রে আপনার অভিনয় ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিল। এ সিনেমার পেছনের গল্পটা কী?

কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় নীলকণ্ঠ বাগচীর যে চরিত্রটা—ঋত্বিক ঘটকের, সেটা যখন আমাকে করতে বলে, আমার খুব ভয় করেছিল। আমি ঋত্বিক ঘটকের নাম শুনেছি, উনার সিনেমা দেখেছি কিন্তু মানুষটাকে কোনো দিন দেখিনি। আমাকে ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’র ডিভিডি দেওয়া হয়, যাতে উনি অভিনয় করেছিলেন। সেখান থেকে আমি তোলার চেষ্টা করি, মানুষটা কীভাবে তাকাতেন, কীভাবে হাসতেন, কীভাবে বসতেন, এগুলো রপ্ত করার চেষ্টা করেছি। আমার চেহারার সঙ্গে উনার চেহারার কোনো অংশে মিল নেই। সেখানে দাঁড়িয়ে যখন আমাকে ভেঙ্কটেশ ফিল্মস আর কমলেশ্বর বলে যে তোমাকে চরিত্রটা করতে হবে; সত্যিই একটু চিন্তা হয়েছিল। থিয়েটারে আমার যিনি গুরু ছিলেন, জোছন দস্তিদার, তিনি একটা কথা আমাদের শিখিয়েছিলেন—সৃষ্টির গোড়ার কথায় শুধু সাহস। তো সাহস নিয়ে করে ফেলেছি এবং সেটা মানুষের ভালো লেগেছে।

ফেলুদার সঙ্গে তোপসে হিসেবে আপনাকে আজও মনে রেখেছে দর্শক। এ চরিত্রে আপনাকে নাকি স্বয়ং সত্যজিৎ রায় পছন্দ করেছিলেন?

আমি খুবই ভাগ্যবান। কারণ, আমাকে তোপসে মনোনীত করে গিয়েছিলেন মানিক জেঠুই (সত্যজিৎ রায়)। সেটা একটি বিয়েবাড়িতে। আমাকে বিজয়া জেঠিমা ডাকলেন, ‘এদিকে শোন, কী বলছে!’ উনি (সত্যজিৎ) তখন খাচ্ছিলেন। আমি প্রণাম করে দাঁড়ালাম। উনি বললেন, ‘তুমি খুব ভালো তোপসে হতে পারতে।’ কিন্তু উনি তখন অলরেডি ঘোষণা করে দিয়েছেন, উনি আর ফেলুদা করবেন না। আমি বললাম, আপনি তো আর করবেন না। উনি বললেন, ‘কী করে করব, সন্তোষ (সন্তোষ দত্ত, জটায়ু চরিত্রের অভিনেতা) নেই!’ মানে একজন অভিনেতার প্রতি কতটা ভালোবাসা এবং আস্থা একজন ডিরেক্টরের। জটায়ু চলে গেছে বলে ফেলুদাই আর করলেন না! তারপর উনি আমাকে বলেছিলেন, রবির (অভিনেতা রবি ঘোষ) বয়সটা একটু বাড়লে যদি বাবু (সন্দীপ রায়) কোনো দিন ফেলুদা বানায়, তুমি তোপসে করবে।

পরবর্তী সময়ে ফেলুদার অনেক গল্পে সব্যসাচী চক্রবর্তীর সঙ্গে আপনি তোপসে হয়েছেন। আপনাদের জুটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল…

ফেলুদার সবচেয়ে বেশি গল্প কিন্তু আমরাই করেছি—আমি আর বেনুদা (সব্যসাচী চক্রবর্তী)। আমরা বোধ হয় ১০-১২টা গল্প করেছি। আমি চার্বাকে (নাট্যদল) অভিনয় করতাম। বেনুদাও চার্বাকে অভিনয় করতেন। তোপসে যেমন ফেলুদাকে রেসপেক্ট করে, ফেলুদা তাঁর গুরু; আমার কাছেও বাস্তবজীবনে সব্যসাচী চক্রবর্তী একধরনের গুরু। কাজেই রসায়নটা খুব ইজি হয়ে গিয়েছিল।

[নানা বিষয়ে আড্ডা চলতে থাকে আরও কিছুক্ষণ। বিদায়ের আগে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘আমার খুব ইচ্ছা ছিল, বাংলাদেশে গিয়ে মঞ্চনাটক দেখার। এবার সম্ভব হলো না, দেখা যাক পরে কী হয়!’]





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত