সিনেমার কোনো সীমান্ত নেই, সিনেমা মানে না কাঁটাতারের বিধিনিষেধ—প্রতিবছর ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেটা আরও স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। সিনেমা প্রদর্শনী ও বিকিকিনির এ মহামিলনের ৭৮তম আসরটি শুরু হয়েছিল ১৩ মে, শেষ হলো ২৪ মে মধ্যরাতে। এবারের আসরে জ্বলজ্বলে হয়ে রইল বাংলাদেশের নাম। স্বল্পদৈর্ঘ্য শাখায় স্পেশাল মেনশন পুরস্কার পেয়ে আদনান আল রাজীবের ‘আলী’ গড়ল ইতিহাস।
প্রথমবার কানে পুরস্কার পেল বাংলাদেশের সিনেমা
৭৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে প্রথমবার জায়গা পায় বাংলাদেশের কোনো সিনেমা। প্রথমবারেই বাজিমাত করেছে আদনান আল রাজীব পরিচালিত ‘আলী’। এই বিভাগে স্পেশাল মেনশন পুরস্কার জিতে নেয় সিনেমাটি। কান উৎসবে এটিই বাংলাদেশের প্রথম পুরস্কার। এই বিভাগে সেরা নির্বাচিত হয়েছে তৌফিক বারহোম পরিচালিত ‘আই অ্যাম গ্ল্যাড ইউ আর ডেড নাও’।
১৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের আলী সিনেমার গল্প এক কিশোরকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশের উপকূলীয় একটি শহরে বসবাস করে সে, যেখানে নারীদের গান গাওয়ার অনুমতি নেই। শহরে পাড়ি জমানোর সুযোগ পেতে গানের একটি প্রতিযোগিতায় নাম লেখায় আলী। সে নারীকণ্ঠেও গান গাইতে পারে। আলী সিনেমায় নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন আল আমিন। নির্মাতা আদনান আল রাজীব কান উৎসবে এই সিনেমার অর্জনও আলীর মতো মানুষদের উৎসর্গ করেছেন, যাঁরা সমাজে নিজেদের কণ্ঠ তুলে ধরতে চান।
আদনান আল রাজীব বলেন, ‘যাঁরা চুপ থাকেন, যাঁরা নানা চাপে কথা বলেন না, আলী তাঁদের উৎসর্গ করছি। আমাদের সিনেমাটি মূলত কণ্ঠস্বর জাগ্রত করা নিয়ে। আমি আলীর এই অর্জন উৎসর্গ করতে চাই তাঁদের—যাঁরা আলীর মতো দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন, যাঁরা চুপ করে আছেন কিন্তু নিজেদের কণ্ঠস্বর জাগ্রত করতে চান।’
রাজীব মনে করেন, আলীর এই অর্জন বাংলাদেশকে আরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি দেবে। নির্মাতা বলেন, ‘এই পুরস্কার আমাদের দেশের জন্য বিশেষ। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ একটা অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমরা চাই বাংলাদেশে পজিটিভ কিছু আসুক। এই পুরস্কারটি জিতে আমরা কিছুটা হলেও সেটাই দিতে পেরেছি। এটা দেশের মানুষের মধ্যে একটা আশার সঞ্চার যেমন ঘটাবে, তেমনি বাংলাদেশ নিয়ে একটা ইতিবাচক ধারণাও তৈরি করবে।’
ফিরেই চমকে দিলেন জাফর পানাহি
২২ বছর পর কানের মঞ্চে ফিরে চমক দেখালেন ইরানি নির্মাতা জাফর পানাহি। জুরিপ্রধান জুলিয়েট বিনোশ যখন পাম দ্য’র বিজয়ী হিসেবে তাঁর ‘ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাকসিডেন্ট’ সিনেমার নাম ঘোষণা করেন, তুমুল হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ে গোটা মিলনায়তন। চেয়ারে বসেই দুই হাত উঁচু করে উল্লাস প্রকাশ করেন জাফর পানাহি। মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে দর্শকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। কালো চশমার আড়ালে তাঁর চোখজোড়া নিশ্চয়ই অশ্রুসিক্ত হয়েছিল তখন!
সিনেমা নির্মাণের জন্য বারবার ইরান সরকারের বাধার মুখে পড়েছেন পানাহি। একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। একসময় তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণের ওপর ২০ বছরের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। চিত্রনাট্য লেখা, বিদেশযাত্রা—সবই ছিল তাঁর জন্য নিষিদ্ধ। তবুও পানাহি থেমে থাকেননি। গৃহবন্দী থাকা অবস্থায়ই একের পর এক সিনেমা বানিয়ে গেছেন। সর্বশেষ তাঁকে ২০২২ সালে গ্রেপ্তার করা হয়। সেবার প্রায় আট মাস ছিলেন কারাগারে।
জাফর পানাহির নতুন সিনেমা, যেটা এবার কান উৎসবের সেরা সিনেমা হিসেবে পুরস্কার পেল, সেই ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাকসিডেন্ট তৈরি হয়েছে তাঁর সেই সময়ের কারাবাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে। কারাগার থেকে বেরিয়ে আবারও তিনি এ সিনেমায় ইরান সরকারের কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার ওপর সরাসরি আক্রমণ করেছেন। এ রাজনৈতিক থ্রিলারটি তৈরি হয়েছে পাঁচজন রাজনৈতিক বন্দীকে ঘিরে। এক প্রসিকিউটরকে অপহরণ করে তারা, কারাবন্দী থাকা অবস্থায় যে তাদের ওপর নির্যাতন করেছিল। পাঁচটি চরিত্র পরস্পরের মধ্যে তর্ক করে, তাকে হত্যা করবে নাকি ক্ষমা করে দেবে!
কান উৎসবে সেরা সিনেমার পুরস্কার পাওয়ার পর শিল্পের স্বাধীনতার প্রসঙ্গই উঠে আসে জাফর পানাহির মুখে। ইরানের যেসব নির্মাতা এখনো বন্দী কিংবা সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে সিনেমা বানাতে পারছেন না, তাঁদের স্বাধীনতার কথা বলেছেন তিনি। বলেছেন ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার কথা। পানাহি বলেন, ‘আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। আমাদের কী ধরনের পোশাক পরা উচিত, কোনটা করা উচিত, কোনটা নয়—এ বিষয়ে কথা বলার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমাদের দেশ ও দেশের স্বাধীনতা।’