Homeলাইফস্টাইলগন্তব্য হারং হুরং

গন্তব্য হারং হুরং


পড়ন্ত দুপুরে আমরা তিনজন। বাগানের আঁকাবাঁকা পথ অতিক্রম করতে হবে, এই ভেবে বাইক সঙ্গে নিলাম। চৌহাট্টা, আম্বরখানা, লাক্কাতুরা চা-বাগানকে পাশ কাটিয়ে মিনিট দশেকের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম দেশের প্রথম চা-বাগান মালনীছড়ার মূল কার্যালয়সংলগ্ন রাস্তার মাথায়। বাগানটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৫৪ সালে। জগন্নাথ নামে চা-বাগানের এক কুলিকে পথপ্রদর্শক হিসেবে পেয়ে গেলাম।

চা-বাগানের পথ ধরে এগিয়ে চলছি। এক-দেড় কিলোমিটার পরেই বাগানের বালুময় পথের শুরু। দুপাশে নাতি-উচ্চ টিলায় সুবিন্যস্ত চা-বাগান। তার মাঝে সোজা আকাশের দিকে উঠে যাওয়া ছায়াবৃক্ষ মিলে আশ্চর্য এক সবুজের ধারা তৈরি করেছে। অসাধারণ এক প্রাকৃতিক মোহের মাঝে আমরা এগিয়ে চলেছি। বৃষ্টি হওয়ায় বাগানের ছড়াগুলোতে পানির প্রবাহ বেশি। কিছু পথ বৃষ্টির কারণে ভাঙাচোরা। পথে যেতে যেতে জগন্নাথ জানালেন, বাগানের লোকজনের কাছে হারং হুরং সুড়ঙ্গ গৌরগোবিন্দ রাধা গুহা নামে পরিচিত। তাঁরা প্রতি শনি ও মঙ্গলবার সেখানে পূজা দেন। গল্প করতে করতে আমরা পৌঁছে গেলাম তেলিহাটি চা-বাগানে। এখানে এসে গাইড জগন্নাথ আবিষ্কার করলেন, আমরা ভুল পথে চলেছি।

নিস্তব্ধ পরিবেশ জনমানবশূন্য। মনে মনে ভাবছিলাম, এমন নিঝুম পরিবেশে মানুষ থাকে কী করে! হঠাৎ আমার এক সঙ্গী জানালেন, প্রায় আধা ঘণ্টা হতে চলল। কিন্তু গাইড জগন্নাথ ফিরছেন না। এদিকে সন্ধ্যা হতে চলেছে। কোনো নেটওয়ার্ক নেই। আরেক সঙ্গী জানালেন, বাইকে তেল খুব বেশি নেই। এসব ভেবেচিন্তে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাদের সামনের দিকে না গিয়ে ফিরে যাওয়া উচিত।

আমরা ফিরছি। কিছুক্ষণ পর মনে হলো, ঠিক পথে ফিরছি তো! পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে ভুল হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। খেয়াল করলাম, মোটরসাইকেলের চাকার কোনো দাগ নেই রাস্তায়। দেরি না করে আমরা মোটরসাইকেলের চাকার দাগ খুঁজতে লাগলাম। অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেল। কিছু দূর যেতেই দেখা গেল, জগন্নাথ ঘেমেনেয়ে দৌড়ে আসছেন আমাদের দিকে। খানিক দম নিয়ে জানালেন, তিনি তাঁর এক কাকাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। এবার জগন্নাথ আর তাঁর কাকা জগবন্ধুকে নিয়ে ২০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম এক বুনো পরিবেশে।

তেলাহাটির দক্ষিণে হিলুয়াছড়া চা-বাগান। তার ১৪ নম্বর সেকশনের পাশে হারং হুরং সুড়ঙ্গ। ঝিঁঝি পোকার ডাক, পাহাড় আর জঙ্গল যেন আমন্ত্রণ জানাল হারং হুরংয়ে। সিলেটি ভাষায় ‘হারং’ মানে সাঁকো বা বিকল্প পথ আর ‘হুরং’ মানে ‘সুড়ঙ্গ’। অর্থাৎ ‘হারং হুরং’ মানে হলো বিকল্প সুড়ঙ্গ পথ।

সুড়ঙ্গে যাওয়ার পথ

সুড়ঙ্গে যাওয়ার পথ

এখানে একদিকে সবুজ পাহাড়ি অরণ্য, অন্যদিকে তিনটি সুড়ঙ্গ। সেগুলো বেশ অন্ধকার। আমরা চারজনই পালা করে সেগুলোতে ঢুকলাম, ছবি তুললাম। কিন্তু অন্ধকার আর ভয়াল পরিবেশের কারণে ভেতরে বেশি দূর গিয়ে দেখার সাহস হলো না। এর মধ্যে আমার এক সঙ্গী ভেতরে কিসের যেন শব্দ শুনতে পেল। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আমরা দেখলাম, ভেতরে অসংখ্য বাদুড়। মূল সুড়ঙ্গটি বালু দিয়ে প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। থেমে থেমে টিলা চুইয়ে আসা পানির টিপ টিপ শব্দ আর বাদুড়ের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ নিশ্চিতভাবে কোনো হরর ছবির কথা মনে করিয়ে দেবে।

বড় সুড়ঙ্গের ভেতরে দাঁড়ানো যায়। তবে একটু এগোলেই মাটির দেয়াল দিয়ে বন্ধ। স্যাঁতসেঁতে দেয়ালে ধরেছে শেওলা। মোবাইল ফোনের আলো সুড়ঙ্গের অন্ধকার ভেদ করতে পারছে না। বেশি ভেতরে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। বিষধর সাপ, পোকামাকড় থাকা খুবই স্বাভাবিক। হয়তো অনেক রহস্যও লুকিয়ে রয়েছে সেখানে। তার মাঝে এক খোঁড়লের মধ্যে মোমবাতি আর আগরবাতি দেখে বুঝলাম, এখানে চা-শ্রমিকেরা পূজা দেন।

অভিজ্ঞ মানুষ জগবন্ধুকে আমরা জিজ্ঞেস করলাম, এই সুড়ঙ্গ কত দূর পর্যন্ত গেছে। কেউ এর শেষ প্রান্তে যেতে পেরেছিল কি না। তিনি জানালেন, সুড়ঙ্গটির বয়স ৭০০ বছর কিংবা তারও বেশি হতে পারে। যদিও অনেকে বলে থাকেন, জৈন্তা পর্যন্ত গেছে এই সুড়ঙ্গ। তিনি আরও জানালেন, যাঁরাই এর ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন, তাঁদের প্রায় কেউই জীবন নিয়ে বের হয়ে আসতে পারেননি। আর যে দু-একজন ফিরে এসেছিলেন, তাঁরাও কিছুদিনের মধ্যে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে মারা গেছেন। উপস্থিত থাকা আরেকজন জানালেন, ভারত থেকে বেশ অনেক বছর আগে তিনজন তান্ত্রিক প্রধান গুহায় প্রবেশ করেছিলেন। তাঁদের একজন ফিরে এসে অল্প কয়েক দিন বেঁচে ছিলেন; তবে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন।

এ ছাড়া সিলেটের একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী নাকি খননের উদ্যোগ নিয়েছিলেন এই সুড়ঙ্গ। পরে তিনি অস্বাভাবিক স্বপ্ন দেখে সংস্কারকাজ মাঝপথে বন্ধ করে দেন। আর এই গ্রামের এক বুড়ো জোয়ানকালে ঢুকেছিলেন সেখানে। তারপর বেরিয়ে এসে পাগল হয়ে যান। এসব কথা শুনে বিশ্বাস না করলেও কিছুটা শিহরিত হলাম আমরা চারজন।

কীভাবে যাবেন

দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে সিলেটে যেতে হবে। সিলেটের আম্বরখানা থেকে অটোরিকশায় তেলাহাটির হিলুয়াছড়া চা-বাগানে যাওয়া যায়। মালনীছড়া চা-বাগানের মূল কার্যালয়ের সামনে থেকে গাইড নিয়ে তাঁদের সঙ্গে সিএনজিচালিত অটোরিকশা অথবা টমটমে করে তেলিহাটি। ভাড়া জনপ্রতি ২০ টাকা। রিজার্ভে ভাড়া যাওয়া-আসা ৪০০ টাকার মতো। অবশ্যই গাইড সঙ্গে নিতে হবে। তবে ২০০ টাকার মধ্যেই গাইড পাওয়া যাবে। বাইকে যাওয়ার ক্ষেত্রে মালনীছড়া বাগান থেকে অনুমতি নিতে হবে।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত