ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মানবসভ্যতার বিভিন্ন স্মারক স্মরণ করতে প্রতিবছর ১৮ মে আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস হিসেবে পালিত হয়। ১৯৭৭ সাল থেকে ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব মিউজিয়ামসের আহ্বানে এটি বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে। বর্তমানে ১৮০টি দেশের ২৮ হাজারের বেশি জাদুঘর এই আয়োজনে যুক্ত। এর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় পুরোনো জাদুঘরের খোঁজ পাওয়া যায় উনিশ শতক থেকে। এরপর থেকে এই অঞ্চলে তৈরি হয়েছে প্রচুর জাদুঘর। দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীন জাদুঘরের তালিকায় আমাদের দুটি জাদুঘর রয়েছে। এগুলোকে স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছে উত্তরাধিকার হিসেবে।
ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম
ভারতবর্ষের প্রাচীনতম ও বৃহত্তম জাদুঘর হিসেবে খ্যাত ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম। ইম্পিরিয়াল মিউজিয়াম অব ক্যালকাটা নামে পরিচিত জাদুঘরটি কলকাতার পার্কস্ট্রিটে অবস্থিত। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮১৪ সালে। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে আজও এটি সমান গুরুত্বপূর্ণ।
এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন ড্যানিশ উদ্ভিদবিদ নাথানিয়েল ওয়ালিচ। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলের সহায়তায় প্রথমে একটি ছোট সংগ্রহশালা গড়ে তোলেন। সময়ের সঙ্গে সেটি রূপ নেয় একটি পূর্ণাঙ্গ জাদুঘরে। ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে রয়েছে ছয়টি মূল বিভাগ, প্রতিটিই ইতিহাস, শিল্প ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় তুলে ধরে। এখানে সংরক্ষিত রয়েছে গৌতম বুদ্ধের পবিত্র দন্তাবশেষ, সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন, মিসরের এক আসল মমি, ডাইনোসরের কঙ্কালসহ বহু দুর্লভ সংগ্রহ। স্থাপত্যশৈলীতেও ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম অনন্য। ক্ল্যাসিক ইউরোপীয় নকশায় নির্মিত ভবনটি রাজকীয় ও প্রশস্ত। এর প্রতিটি গ্যালারি ইতিহাস ও নান্দনিকতার এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য জাদুঘরটি সপ্তাহে ছয় দিন খোলা থাকে—প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। শিক্ষার্থী, গবেষক ও ইতিহাসে আগ্রহী সবার জন্য এটি একটি অসাধারণ জ্ঞানভান্ডার।

লাহোর মিউজিয়াম
১৮৬৫ সালে একটি ছোট্ট ভবনে যাত্রা শুরু হয়েছিল লাহোর মিউজিয়ামের। ১৮৯৪ সালে বর্তমান ভবনে স্থানান্তরিত হওয়ার পর থেকে এটি পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এটি পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোরের শাহরাহ-ই-কায়েদ-ই-আজম বা দ্য মল বা মল রোডে অবস্থিত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে নির্মিত এই দালান ইন্দো-সারাসেনিক স্থাপত্যশৈলীতে গড়ে তোলা। ভবনে পা রাখতেই মনে হয় যেন টাইম মেশিনে চেপে চলে এসেছি হাজার বছর পেছনে।
জাদুঘরের প্রতিটি কক্ষ, প্রতিটি ভাস্কর্য, প্রতিটি চিত্রকর্ম গল্প বলে সিন্ধু সভ্যতার উন্মেষ থেকে শুরু করে মুঘল আমল, ঔপনিবেশিক শাসন থেকে পাকিস্তানের জন্ম পর্যন্ত। একটি গ্যালারিতে রয়েছে গান্ধারা শিল্পের অসাধারণ নিদর্শন—বুদ্ধের মুখে খোদাই করা গাম্ভীর্য। আরেকটি কক্ষে রক্ষিত আছে মুঘল আমলের চিত্রশিল্প, যেখানে বাদশাহদের রাজসভা, শিকারযাত্রা ইত্যাদি রাজকীয় দৃশ্য ফুটে উঠেছে। জাদুঘরটিতে রয়েছে ৪০ হাজারের বেশি প্রাচীন মুদ্রা, অস্ত্রশস্ত্র, ইসলামি শিল্পকর্ম, হিন্দু ও বৌদ্ধ ভাস্কর্য, এমনকি তিব্বতি ধর্মীয় নিদর্শনও। ১৮৯৪ সালে জাদুঘরটিতে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়। যেটি দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস ও সংস্কৃতিবিষয়ক দুর্লভ পাণ্ডুলিপি ও বইয়ে সমৃদ্ধ।
কলম্বো ন্যাশনাল মিউজিয়াম
কলম্বোর ব্যস্ত রাজপথ ধরে স্যার মার্কাস ফার্নান্দো মাওয়াথা ধরে এগিয়ে গেলে একসময় যে বিশাল সাদা রঙের রাজকীয় ভবন চোখে পড়বে, সেটিই কলম্বো ন্যাশনাল মিউজিয়াম। শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় ও প্রাচীনতম জাদুঘর এটি। ১৮৭৭ সালের ১ জানুয়ারি ব্রিটিশ শাসনামলে তৎকালীন গভর্নর স্যার উইলিয়াম হেনরি গ্রেগরির উদ্যোগে জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময়ে শ্রীলঙ্কা অর্থাৎ তৎকালীন সিলন ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ। শাসকেরা উপলব্ধি করেছিলেন, এই দ্বীপ দেশটির ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জীববৈচিত্র্য এতটাই সমৃদ্ধ যে, সেগুলোকে সংরক্ষণের জন্য একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান দরকার। সেই ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় এই জাদুঘর। এর মূল ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন ব্রিটিশ স্থপতি জেমস স্মিথার। বিশাল করিডর, খোলা বারান্দা ও উঁচু ছাদ—সবকিছুতে ফুটে আছে ঔপনিবেশিককালের শিল্প।
এর একটি গ্যালারিতে দেখা যায় প্রাচীন বৌদ্ধ ভাস্কর্য, আরেকটিতে শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার চিত্র। একটি গ্যালারিতে আছে বিশাল নীল তিমির কঙ্কাল। এ ছাড়া রয়েছে লাইব্রেরি। ১৮৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই গ্রন্থাগারে রয়েছে প্রায় ১২ লাখ নথি। এর মধ্যে অনেক দুর্লভ তালপাতার পাণ্ডুলিপি ও প্রাচীন শাস্ত্র রয়েছে। জাদুঘরটি শুধু শ্রীলঙ্কার অতীতকে ধরে রাখেনি, বরং প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্যে ইতিহাসচর্চার আগ্রহ জাগিয়ে তুলেছে।
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর
বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। রাজশাহী মহানগরের হাতকড়া সদর হাসপাতালের সামনে অবস্থিত এই জাদুঘর। এ জাদুঘরে উত্তরের বরেন্দ্র অঞ্চলের পাল, সেন, মৌর্য, গুপ্ত আমলসহ হাজার হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। গবেষকেরা ছাড়াও দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীরা এ জাদুঘর পরিদর্শনে যান।
নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজপরিবারের জমিদার কুমার শরৎকুমার রায়, খ্যাতনামা আইনজীবী ও ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় এবং রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক রমাপ্রসাদ চন্দ্রের প্রচেষ্টায় ১৯১০ সালে এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। নির্মাণ শেষে ১৯১৯ সালের ২৭ নভেম্বর লর্ড রোনাল্ডসে জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন।
বর্তমানে এটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন। বরেন্দ্র জাদুঘরে বর্তমানে পাণ্ডুলিপিসহ ১১ হাজার ৩৩১টি প্রত্ননিদর্শন রয়েছে। গ্যালারি রয়েছে ১৪টি। জাদুঘরের এ পর্যন্ত সংগ্রহ সংখ্যা সাড়ে আট হাজারেরও বেশি।
বালাদেশ জাতীয় জাদুঘর
ঢাকার শাহবাগে ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর। প্রথমে এটি ঢাকা জাদুঘর নামে পরিচিত ছিল। জাদুঘরের ভেতরে ঢুকলে মনে হয়, আপনি আর কোনো আধুনিক শহরে নেই, সময়ের হাত ধরে হাঁটছেন অতীতে। প্রথমেই আপনার চোখে পড়বে প্রাকৃতিক ইতিহাস গ্যালারি—সেখানে আছে দুর্লভ সব প্রাণীর মডেল, খনিজ পদার্থ আর প্রকৃতির অপার বিস্ময়।
তারপর হঠাৎ করেই আপনি ঢুকে পড়বেন প্রাচীন সভ্যতা গ্যালারিতে। সেখানে রয়েছে মহাস্থানগড়, ময়নামতি, পাহাড়পুরের নিদর্শন; আছে পাথরের মূর্তি, পোড়ামাটির ফলক আর বৌদ্ধ স্থাপত্যের ক্ষুদ্র প্রতিরূপ। এসবের সামনে দাঁড়ালে মনে হবে, আপনি হাজার বছর আগের বাংলায় চলে এসেছেন। এ জাদুঘরে আছে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্রাচীন বিভিন্ন শিল্পের নিদর্শন। আছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের নিদর্শন।
প্রাচীন জাদুঘরের সবচেয়ে আবেগঘন অংশ নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারি। এখানে ঢুকলে হঠাৎ এক ভারী নীরবতা নেমে আসে। দেয়ালে দেয়ালে শহীদদের ছবি, যুদ্ধের সরঞ্জাম, গণহত্যার সাক্ষ্য—সব মিলিয়ে গড়ে ওঠে এক করুণ কিন্তু গর্বিত ইতিহাস। ১৯৭১ সালের প্রতিটি মুহূর্ত যেন সেখানে জমা রাখা আছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।